শিশুর বুদ্ধির বিকাশ – শিশুর মেধা ও বুদ্ধি বাড়ানোর উপায় – Baby Brain

শিশুর বুদ্ধির বিকাশ – শিশুর মেধা ও বুদ্ধি বাড়ানোর উপায়: আমরা অনেকেই ভেবে থাকি, শিশুদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে অটোমেটিক তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। এতে বেশি কিছু করার নেই। কিন্তু এই ধারণাটি একেবারেই ভুল। শিশুদের বুদ্ধি অর্থাৎ মেধা বাড়ানোর নানা কৌশল আছে। যা সময় মত প্রয়োগ করে শিশুর মেধা বাড়ানো যেতে পারে।

জন্মের সময়, আপনার শিশুর মস্তিষ্কে ১০০ বিলিয়ন নিউরন থাকে (মিল্কিওয়েতে যতগুলি তারা রয়েছে!) আর প্রথম বছরেই সে কোটি কোটি ব্রেন-সেল সংযোগ স্থাপন করে, যাকে নিউরাল সিনাপেস বলে। বেশ আশ্চর্যকর, তাই না?

আপনি যখন শিশুর সাথে হাসিমাখা মুখে ভালোবাসার সহিত কথা বলেন তখন তার মস্তিষ্কের নিউরাল সিনাপেস এবং পথগুলিকে একসাথে মজবুত হওয়ার আরও বেশি সুযোগ করে দিচ্ছেন। যার ফলে, ঐ শিশুটি সহজে ভাষা শিক্ষা, যুক্তি এবং পরিকল্পনা দক্ষতা অর্জন করে। তাই শিশুর বুদ্ধির বিকাশে আপনাকে বাহ্যিক ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।

শিশুর বুদ্ধির বিকাশ কেন হয় না?

  • প্রথমত, জিনগত বা অনেক সময় বংশগত কারণেও শিশুর মেধার বিকাশ হয় না।
  • পুষ্টিকর খাবারের অভাব থাকলে
  • মায়েদের স্বাস্থ্যজ্ঞানের অভাব না থাকার কারণে।
  • বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে এমন সময়টাতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ও অত্যধিক ঔষধ ব্যবহারের কারণে।
  • গর্ভবতী মায়েরা অপুষ্টিতে ভুগলে।
  • মায়েদের অসচেতনতার কারণে।
  • পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতার অভাবে। কেননা, এই তিনটি জিনিস শিশুর বুদ্ধির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • ভালো কাজের প্রশংসা না করে শিশুকে অনুৎসাহিত, তিরস্কার বা নিন্দা করলে।
  • এছাড়া অশোভন আচরণ ও পারিবারিক ঝগড়া শিশুর বুদ্ধির বিকাশে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

মেধাহীন শিশুর যে ধরনের সমস্যা হয়

সাধারণত মেধাহীন শিশুদের নানা ধরনের জটিলতা দেখা যায় –

  • মেধাহীন শিশুরা সাধারণত রাগ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
  • নিজেকে সব সময় লুকানোর চেষ্টা করে।
  • এ সমস্ত শিশুদের আচরণে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়।
  • বুদ্ধিহীন শিশুরা বড় হয়ে পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে সরাসরি ব্যাহত করে।
  • জটিল সমস্যা সমাধানে ভয় পায়। কাজে অনীহা প্রকাশ করে।
  • খাবার গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে।
  • কোনো কিছু জিঙ্গাসা করলে চেষ্টা ছাড়াই ‘না’ সূচক জবাব পাওয়া যায়।
  • ব্যক্তিগত দক্ষতা লক্ষণীয় হয় না।
  • স্কুল কলেজের ফলাফল সন্তোষজনক হয় না।
  • অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা লক্ষণীয় হয়।
  • পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়।

শিশুর বুদ্ধি বা ব্রেন বাড়ানোর উপায়

একজন শিশুর বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে আপনার করণীয় বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরলাম –

১। জন্মের আগেই শিশুকে একটা ভালো পরিবেশ দিন

প্রেগন্যান্সির সময় আপনার স্বাস্থ্যবান থাকাটা খুবই জরুরি। তবে এটাও জেনে রাখুন, বেশ কিছু ঔষধ জরায়ুতে শিশুর মস্তিষ্কের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। প্রেগন্যান্সির সময় আপনি যদি মাদক সেবন করেন তাহলে এর পার্শ্‌বপ্রতিক্রিয়া শিশুর শরীর ও ব্রেনের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। শিশুর মাঝে আক্রমণাত্মক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। গবেষণায় আরও জানা গেছে যে, গর্ভাবস্থায় ধূমপান নিম্ন চতুর্থ শ্রেণির পড়ার স্কোরের সাথে যুক্ত।

২। শিশুকে নানা ধরণের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করুন

শিশুদের বুদ্ধিমান বানাতে তাদের উদ্বুদ্ধ রাখতে হয়। পাশাপাশি তাদের আগ্রহী করে তুলতে অভিনব সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে হয়। কেননা, জীবনে ঘটে যাওয়া বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা শিশুদের সাহস বাড়িয়ে তোলে ও তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, দিনের পর দিন একই রকম গতানুগতিক জীবন আলস্য, স্থবিরতা ডেকে আনে।

৩। মায়ের দুধ

মায়ের দুধ শিশুর জন্য সবচেয়ে পুষ্টিকর খাদ্য। শিশুকে কমপক্ষে ৬ মাস মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। কেননা, শিশুর বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে মায়ের বুকের দুধ অপরিমেয় ভূমিকা পালন করে। ব্রাজিলের এক দল গবেষক সাড়ে তিন হাজার শিশুর উপর দীর্ঘদিন নজর রাখার পর এ সিদ্ধান্তে আসেন।

৪। তাদের প্রতিভা এবং আগ্রহকে উৎসাহিত করা

খেলাধুলা, নাটকের ক্লাস, সংগীত কিংবা নাচ, যাই হোক না কেন এসব নিয়ে যদি আপনার শিশুর আগ্রহ থাকে তবে তাকে ছোট বয়স থেকেই সুযোগ দিতে হবে। তবেই শিশুর প্রতিভা বিকাশের সম্ভাবনা অনেক হারে বৃদ্ধি পাবে।

তবে বাচ্চার উপর নিজের অপূরণীয় ইচ্ছাগুলো কখনো চাপিয়ে দিবেন না। কারণ এতে হিতের বিপরীত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি চান শিশুকে ডাক্তার বানাতে, কিন্তু শিশু চায় গান গাইতে। আপনি জোর করে তাকে কোনো কিছু করাতে গেলেই সেটা অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই হবে না। তাই তাকে তার মতই বড় হতে দিন। বরং তার পাশে দাঁড়িয়ে তার উদ্দীপনা ও আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে তুলুন। শিশুর মানসিক বিকাশে আপনাকে এভাবে সহযোগিতা করতে হবে।

৫। শিশুর সাথে কথোপকথোন করুন

আনন্দ ও উৎফুল্লতার সহিত হাসিমাখা মুখে শিশুর সাথে কথোপকথন করুন। শিশুর ছোট ছোট উচ্চারণগুলির প্রতিক্রিয়া জানান এবং আপনিও ছোট ছোট শব্দ তাকে শোনান। যেমনঃ ‘আমার সোনা বাবুটা’, ‘মিষ্টি বাবু’, ‘বাবুর লাল জামা’ ইত্যাদি। এইরকম বলার উপায়কে পেরেন্টটিস বলা হয়।

এর ফলে শিশু আপনার অতিরঞ্জিত মুখের ভাবগুলি এবং উচ্চারিত শব্দগুলি মনে রাখে। বক্তৃতা বোঝার এবং ভাষা তৈরির জন্য দায়ী শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষেত্রগুলিকে আপনাকেই জাগ্রত করাতে হবে। তবেই শিশুর ব্রেন পাওয়ার ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাবে।

৬। মার্তৃগর্ভেই শিশুকে শেখান

শিক্ষা গ্রহণের নির্ধারিত কোনো সময় নেই। শিশু সাধারণত মার্তৃগর্ভ থেকেই শেখা শুরু করে। মায়ের গর্ভে শিশুর বয়স যখন সবে মাত্র ৬ মাস তখন থেকেই শিশু আমাদের কথাগুলোর প্রতিক্রিয়া জানায়। যদি আপনি শিশুকে পূর্ণাংগ ব্যক্তিত্ব দিতে চান তবে তখন থেকেই আপনাকে কাজ শুরু করতে হবে। শিশুকে কোন দিকে আপনি নিয়ে যেতে চান সে কাজগুলো বেশি বেশি করুন।

উদাহরণস্বরূপ, কোনো প্রেগনেন্ট মা যদি গর্ভাবস্থায় কিংবা পরবর্তী সময়েও টিভিতে প্রচুর পরিমাণে নাচ গান দেখেন, তবে শিশুর অটোমেটিক নাচ গানের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। পক্ষান্তরে, যদি নামাজ পরেন, ইসলামিক গজল শোনেন, মানুষকে ভালো ভালো কথা বলেন, তবে শিশু অটোমেটিক পরহেজগার হবে। এখন তাকে আপনি কোন পথে নিয়ে যাবেন সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার। তাই মায়ের পেটের কাছে মুখ নিয়ে তার সাথে গল্প করুন, ভালো ভালো কথা শোনান।

৭। জানা বা শেখার চেষ্টার প্রশংসা করুন, তার ক্ষমতাকে নয়

‘নতুন কোনো কিছু শেখার আগ্রহ’ যদি আপনার শিশুর মধ্যেও থেকে থাকে তবে তার এই গুণটি দমিয়ে যেতে দিবেন না। এ গুণটি সব বাচ্চাদের মধ্যে থাকে না। তাই এটা ধরে রাখতে তার শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে বেশি বেশি প্রশংসা করুন।

গান শেখার জন্য তার চেষ্টা, সাইকেল চালানোর জন্য তার চেষ্টা, ছবি আঁকা শেখার জন্য তার চেষ্টা, এমনকি নতুন কোনো ভাষা শেখার জন্য তার চেষ্টা – এসব বিষয়কে উৎসাহিত করুণ। তাই বলে, যে জিনিসটা শিখলে তার জন্য পরবর্তীতে বিপজ্জনক হতে পারে তা থেকে দূরে রাখুন। শেখার চেষ্টা, জানার চেষ্টা শিশুর মধ্যে থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, একমাত্র নতুন কিছু শেখার চেষ্টাটাই তাকে সহজেই সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিবে।

৮। হাত জড়িত গেম খেলুন

হাড়িপাতিল, ঘর বানিয়ে খেলা, পাখি উড়ে, হাতে তালি দিয়ে খেলা এমনকি বিভিন্ন ধরনের পুতুল খেলাগুলোও আপনার শিশুকে কাজের মধ্যে জড়িত রাখে এবং শিশুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হাত ব্যবহার করে এই ধরনের খেলাগুলো তাদের এটা শিক্ষা দেয় যে কীভাবে আমরা বিশ্বের সাথে শারীরিকভাবে ইন্টারঅ্যাক্ট করি। এছাড়া হাতে তালি দিয়ে খেলাগুলো শিশু ও আপনার উভয়ের জন্যই বেশ মজাদার।

৯। ব্যর্থতা ভীতিকর কিছু নয়

আপনি আমি সবাই এটা জানি যে সফলতা সহজ কোনো বিষয় নয়। আপনি কিন্তু জন্মের পরদিনেই হাঁটা শিখেননি, একদিনেই সাইকেল চালানো শিখেননি, জন্মের পরদিনেই কথা বলতে শিখেননি। জীবনে কোনো কাজ করতে গিয়ে একটা ভুলও হয়নি এমন নজির খুব কম বা নেই বললেই চলে।

তাই শিশুর করা ভুলগুলোকে শিক্ষার একটা অংশ হিসেবে ধরে নিতে হবে। শিশুরা যত বেশি ভুল করবে তত বেশি শিখবে। তবে আপনাকে এখানে বিচারক হিসেবে কাজ করতে হবে এবং তার ভুলটি শুধরিয়ে তাকে সঠিক জিনিসটা গ্রহণে সাহায্য করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো ভুল করলে বাচ্চাদের ভবিষ্যতে সঙ্কট মোকাবেলার ক্ষমতা বাড়ে।

১০। মনযোগী হন

যখন আদরের বাবুটা কোনো কিছু নিতে বা দেখতে ইঙ্গিত করবে তখন আপনি ছোট ছোট বাক্যে ঐ জিনিসটি সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্য করুণ। ধরুন, বাবুটা একটা শার্টের দিকে ইঙ্গিত করছে। তাহলে আপনি বলতে পারেন ‘ওয়াও! কি সুন্দর লাল শার্ট!’, ‘এটা পরলে তোমাকে দারুণ লাগবে।’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে বাচ্চা আপনার কথার মধ্য থেকে শিক্ষা খুঁজে নিবে। তাই বাবুর ব্রেনকে পাওয়ার করার জন্য নিজেকেও মনোযোগী হতে হবে।

১১। শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ

প্রতিভাবান বাচ্চারা সাধারণত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ চায়। কেননা, তারা তাদের নিজস্ব গতিতে শিখতে ভালোবাসে। তারা হাজারো প্রশ্নের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। আর সেগুলোর সঠিক উত্তর জানাটা তাদের জন্য অতীব জরুরি। তাই চলতি শিক্ষার পাশাপাশি শিশুর সেই বিশেষ চাহিদা পূরণে অভিভাবকদের উচিত শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখা।

১২। শিশুর নিজের দেহের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করুণ

পড়তে, খেলতে বা ডায়াপার বদলানোর সময় শিশুর পেট ও মাথার চুলগুলো আলতোভাবে নাড়িয়ে দিন। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সকল শিশুদের শরীর ও মাথায় কম স্পর্শ পড়ে সে সকল শিশুদের বুদ্ধি তাদের স্বাভাবিক বয়সের তুলনায় অনেক কম হয়। পাশাপাশি শিশুদের শরীর স্পর্শ করে কথা বললে তারা আপনার প্রতি মনযোগী হয়। আপনি চাইলে তাকে বডি পার্টস সম্পর্কে শুরু থেকেই জানাতে পারেন। যদিও সে কথা বলতে পারে না, কিন্তু আপনার মুখাভিনয় ও শব্দ বোঝার চেষ্টা করে।

১৩। শিশুর সক্ষমতা যাচাই করুন

বর্তমানে স্কুলগুলোতে কম্পিটিশন ধরে রাখার জন্য শিশুদের বাড়তি চাপ দেওয়া হয়। ফলে তাদের শরীরের ওজনের থেকে ব্যাগেরই ওজন অনেক বেশি হয়। তাই স্কুলের এই বাড়তি চাপ দেওয়ার পূর্বে শিশুর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা সম্পর্কে আপনাকে যথেষ্ট ধারণা নিতে হবে। কেননা, সে তো শূণ্য জ্ঞান নিয়ে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়েছে।

তাই তার অনেক ধরনের অজানা প্রবলেম থাকতে পারে। হয়তোবা, আপনার শিশু বোঝে কম অথবা তার মনোযোগের সমস্যা থাকতে পারে, কিংবা তার অতিমাত্রায় চঞ্চলতার সমস্যা থাকতে পারে। সুতরাং শিশুর কাছে ভালো ফিডব্যাক পেতে চাইলে শিশুকে আগে শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট করে তুলুন।

১৪। শিশুকে পুষ্টিকর খাবার খেতে দিন

শিশুর মস্তিষ্ককে সক্রিয় ও সতেজ রাখার জন্য পুষ্টিকর খাবারের কোনো জুড়ি নেই। কেননা, পুষ্টিকর খাবারগুলো শিশুর বুদ্ধির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মেধা নষ্ট করে এমন ক্ষতিকর খাবারগুলো শিশুর ডায়েট চার্ট থেকে বাদ দিতে হবে। পক্ষান্তরে, শিশুকে রুটিন মাফিক ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, বেশি করে প্রোটিন, জিংক, ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জাতীয় খাবারগুলো খাওয়াতে হবে।

১৫। মেধার বিকাশে শিশুর চাই পর্যাপ্ত ঘুম

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অপর্যাপ্ত ঘুম শিশুর বুদ্ধির বিকাশে বিঘ্ন ঘটায়। খেয়াল করে দেখুন তো, মিনিমাম ৬ ঘন্টার কম ঘুম হলে সারাদিনে আপনাকে কতটা বিরক্ত লাগে। কোনো কাজে ঠিক মত মন বসে না, চোখে সবসময় একটা ঘুম ঘুম ভাব থেকেই যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত ঘুমই দূর করতে পারে সারাদিনের ক্লান্তি। তাই শিশুর মেধার বিকাশে পর্যাপ্ত ঘুমের নিশ্চয়তা করুন।

শিশুর মেধা বিকাশে করণীয়

এগুলো ছাড়াও শিশুর মেধার বিকাশে নিচের বিষয়গুলোর দিকেও নজর রাখা অতীব জরুরি –

  • সৃষ্টিশীল যে কোনো কাজে শিশুকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত রাখুন। এতে সে নতুন নতুন জিনিস জানবে ও শিখবে। যার ফলে বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে।
  • শিশুর প্রশংসা করুন এবং তার ভালো কাজগুলোর জন্য সব সময় উৎসাহিত করুন। এতে সে আরো মনযোগী হবে এবং পূর্বাপেক্ষা অধিক ভালো কাজ করবে।
  • শিশুকে জানার জন্য তাকে বেশি বেশি সময় দিন। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। তার ছোট ছোট চিন্তাগুলোর সঙ্গী হোন। ছুটির দিনগুলোতে চেষ্টা করুন তাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে। তাকে প্রকৃতি সম্পর্কে জানান। এতে তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে।
  • পারিবারিক ঝগড়া কিংবা অশোভন আচরণ শিশুর সামনে কখনোই করবেন না।
  • শিশুকে খারাপ ভাষায় গালামন্দ করা, রাগ দেখানো, ধমক দেওয়া, উচ্চ স্বরে কথা বলা ইত্যাদি কাজগুলো করবেন না। এতে বুদ্ধির বিকাশে বিঘ্ন ঘটে।
  • সমবয়সী কিংবা পরিবার ও সমাজের অন্য শিশুদের সাথে আপনার শিশুকে খেলাধুলার সুযোগ করে দিন। এতে তাদের মেধার বিকাশ কয়েকগুণ হারে বৃদ্ধি পাবে।
  • আপনার অপূরণীয় ইচ্ছাগুলো শিশুর ওপর কখনোই চাপিয়ে দিবেন না। তাকে পছন্দ ও দায়িত্ব নেওয়া শেখান। এতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
  • নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে শিশুকে দূরে রাখুন। নিজে কখনো শিশুর সামনে নেশাদ্রব্য পান করবেন না। পারলে অন্য নেশাগ্রস্থ ব্যক্তিদের থেকেও দূরে রাখুন।
  • শিশুকে পরিবেশের বিভিন্ন জিনিস ও নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। এতে মেধার বিকাশ ঘটে।
  • শিশুকে ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করুন।
  • ভয় দেখিয়ে, মারধর করে ভুলেও বাচ্চাকে শেখাতে যাবেন না।
  • গল্প শুনলে সাধারণত শিশুর কল্পনাশক্তি বাড়্রে। তাই রাতে বিছানায় শুইয়ে তাকে গল্প শোনাতে পারেন।
  • বাচ্চার মগজের ব্যায়াম বাড়ান। নানা বিষয়ে বই পড়ার উত্সাহ দিন।
  • শুধু পড়ালেখা নয়, বাচ্চা যেন রোজ খেলার সুযোগও পায়।
  • বাচ্চার প্রযুক্তির ব্যবহার যেন মাত্রা ছাড়া না হয়, সেদিকে নজর রাখুন।

প্রশ্ন – উত্তর পর্ব

কিভাবে বুঝবেন আপনার বাচ্চা অসীম প্রতিভাধর?

– যে কোনো বিষয় সম্পর্কে সব সময় প্রশ্ন করা।
– মনে রাখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা পরিলক্ষিত হওয়া।
– প্রখর চিন্তাশক্তি ও ভেবে উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা।
– খেলা নিয়ে নতুন নিয়মকানুন তৈরির ক্ষমতা।
– অল্প বয়সেই পড়তে শেখা।
– দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়া।
– সংগীত বা নাচের প্রতি আগ্রহ।
– বিশ্বে বর্তমানে ঘটছে এমন চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে ধারণা।
– কোনো কিছুকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগ্রহ।
– উচ্চমানের রসিকতাবোধ থাকা।


বাচ্চাদের বুদ্ধি বৃদ্ধির খেলা কোনগুলো?

দাবা- খেলাকে বুদ্ধিমত্তার বৃদ্ধি সাধনের প্রথম ধাপ হিসেবে ধরা যেতে পারে। ভেনিজুয়েলার ৪000 শিক্ষার্থীর উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে দাবা খেলে এমন ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই ৪ মাসের মধ্যে আইকিউ স্কোর উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

সুডোকু- সুডোকু খেলাকে ব্রেইনগেম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এটি শিশুর মেধা বিকাশে ও মস্তিষ্ক বিকাশে ব্যাপক সাহায্য করে। এই মজার খেলা আপনার বাচ্চার মধ্যে ইউনিটি বা দলগত শক্তি সম্পর্কে জ্ঞান দেয় একই সাথে শিশুকে মনযোগী ও ঠাণ্ডা মেজাজি হতে সাহায্য করে।

লুডু- বাচ্চার মেধা ও বুদ্ধি বিকাশে আরও একটি অন্যতম সহযোগী খেলা লুডু। বাচ্চার সাথে সুসম্পর্ক গড়তে লুডু খেলতে পারেন। বাচ্চাকে সাপ লুডু খেলার সাথে আগে পরিচয় করিয়ে দিন। একটু একটু করে খেলার নিয়ম কানুন গুলো বুঝিয়ে দিন। মজার এই খেলাটি বাচ্চাদের অংক ভীতি থেকে বের করে আনবে।

পাজল গেম- বাচ্চাকে মেধাবি করে তোলে এই পাজল গেম। মজাদার এই খেলাটি আপনার বাচ্চাকে মনযোগী করে তুলবে। শুধু একটু কষ্ট করে বাচ্চাকে খেলার মজার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

কিউব- বাচ্চাকে বুদ্ধিমান করে তুলতে বা অঙ্ক ভীতি দূর করতে কিউব গেম দারুণ কার্যকরী। বাচ্চাকে ঘরমুখী করতে একটা রুবিস কিউব দিয়ে তার মজা ধরিয়ে দিন, এতে যদি আপনার বাচ্চা বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে তাহলে ক্ষতি কি।

ভিডিও গেম- ভিডিও গেমস বাচ্চার বুদ্ধির বিকাশে দারুণ কাজ করে, তবে কম্পিউটারের প্রতি আসক্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এভোয়েড করতে পারেন। অথবা বাচ্চা কতটুকু সময় কম্পিউটারের সামনে বসে গেমস খেলবে সেটা আপনি নির্ধারণ করবেন।

এছাড়া ট্রেজার হান্ট, ইনডোর বাস্কেটবল, গুনতে শেখানো, রঙ তুলি নিয়ে খেলা সহ মজার সব খেলায় শিশুকে আগ্রহী করে তুলুন।


বাচ্চাদের পড়ানোর উপায় কি?

শিক্ষাবিদরা বহুবার সাবধান করেছেন, “শিশুদের জবরদস্তি করে প্রতিভাবান করে গড়ে তোলার চেষ্টা করলে বা জোর করে পড়ালে হিতে বিপরীত হয়। তাদের নানারকম সামাজিক এবং মানসিক সমস্যা তৈরি হয়।”

আপনার শিশুকে যেভাবে পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেন-

খেলতে খেলতে পড়ান- শিশুরা খেলতে বেশি পছন্দ করেন। তাই তাদের উপরে এমন চাপ কখনই তৈরি করবেন না যে তারা খেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে। তাহলে সে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাকে খেলাচ্ছলে কৌশলে পড়াতে হবে। কোনো বিষয় বাস্তবিক জ্ঞান দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। তাকে খেলার ফাঁকে ফাঁকে পড়তে বলুন।

উদাহরণ দিয়ে শেখান- প্রায় সব বাচ্চারা অঙ্ক ভয় পেয়ে থাকে। তবে উদাহরণ দিয়ে তাকে অঙ্ক শিখিয়ে দিলে তা সহজে বুঝবে এবং মনে রাখবে। যেমন – যোগ, বিয়োগ করানোর সময় তাকে নিয়ে বাজারে যান, প্রাক্টিক্যালি বুঝিয়ে দেন হিসেবটা। দেখবেন সহজে শিখে গেছে এবং তা আর ভুলছে না।

পুরস্কার দিন- আপনার বাচ্চা যদি পড়তে ইচ্ছুক না হয় তাহলে তাকে বলুন যে, এটি পড়ে শেষ করলে তাকে এই পুরস্কার দিবেন। যেমন- বাবা/মা এটি শেষ করলে তোমাকে খেলতে দিব, তোমার পছন্দের খাবার রান্না করব বা রেজাল্ট ভালো করলে তুমি যেটা চেয়েছিলে তা কিনে দিব। একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন দেয়ার কথা বলে কথার খেয়ানত করবেন না, আর অযথা বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস দেয়া থেকে বিরত থাকুন।

গল্প বা ইতিহাস দিয়ে বোঝানো- গল্পের মত করে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো বুঝিয়ে দিন। এতে করে তারা গল্পের মধ্য দিয়েই তা মনে রাখবে এবং কখনও ভুলবে না। আবার শিশুকে কোন বদ অভ্যাস থেকে দূরে রাখতে চাইলে তাকে আপনার বা অন্যের জীবনের গল্প বলুন যেন সেখান থেকে সে নিজেই শিক্ষা নিতে পারে।


শিশুর বুদ্ধি বিকাশে সহায়ক খাবার কোনগুলো?

মায়ের দুধ, শাকসবজি, ডিম, সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল, কলা, শুকনো ফল, পনির, বাদাম, কালোজাম, লাল আপেল, কুমড়ার বীজ, মধু। তবে মায়ের দুধের বিকল্প নেই।

আশা করি, আমাদের এই টিপসগুলো আপনাদের কাজে লাগবে। একটু সময় ও ধর্য নিয়ে এগুলো অনুসরণ করলে আপনার বাচ্চার মেধা সুস্থ্য ও স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠবে। পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করবে। মানবিক ও গর্বিত সন্তানের বাবা-মা হোন এই কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *