শিশুকে শাসন – শাস্তি নাকি প্যারেন্টিং পদ্ধতি – Baby Behavior Guidelines

শিশুকে শাসন – শাস্তি নাকি স্মার্ট টেকনিক অনুসরণ করবেন: শিশু শব্দটার সাথে মিশে আছে অবুঝ একটা ভাব। অজানা, অচেনা আর অবোধ সবটাই থাকে একটি শিশুর মধ্যে। আচ্ছা একটা পাগল যদি আপনাকে ঢিল মারে তাহলে কি আপনিও তার দিকে ঢিল মারবেন? নাহ, কখনই না, কারণ আপনি জানেন যে তার হিতাহিত জ্ঞান নেই। ঠিক তাই একটি বাচ্চা যখন কোন ভুল করে বা বুঝতে চায় না তখন যদি আপনি তাকে মারেন বা ধমক দেন তাহলে একরকম পাগলামি হবে আপনার।

শিশুকে শাসন ও প্রতিপালন

শুধু তাই নয় শিশুর সুস্থ্য স্বাভাবিক বিকাশ ও চরিত্র ব্যাপক প্রভাবিত হবে। আজকে তাই এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলব এবং শাস্তির বদলে কি করা উচিত তা নিয়ে জানাব। চলুন তবে শুরু করা যাক-

আমরা আলোচনা করব, শাস্তি কেন আপনার সন্তানকে জবাবদিহিতা শেখায় না? অথবা সন্তানকে শাস্তি দিলে কি হয় এবং তার প্রতিকার? কোনও শাস্তি ছাড়াই কীভাবে কোনও শিশুকে তার আচরণের জন্য জবাবদিহি করতে হয়?

“আমি সম্প্রতি ফিনিশ শিক্ষামন্ত্রীর একটি উদ্ধৃতি পড়েছিলামঃ “ফিনিশ ভাষায় জবাবদিহিতার কোনও শব্দ নেই। জবাবদিহিতা এমন কিছু – যখন দায়িত্ব শেষ হয় তখন জবাবদিহিতা শুরু হয়। “- শিক্ষক টম।

এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো- আমাদের সন্তানকে তার আচরণের জন্য দায়বদ্ধ রাখা? আমার সংজ্ঞাটি হ’ল এরকম- আমাদের শিশু তার ক্রিয়াকলাপগুলির জন্য দায়বদ্ধতা সংশোধন করে এবং পুনরাবৃত্তি এড়ানো সহ কর্তৃত্বের চিত্র উপস্থিত থাকবে কিনা তা গ্রহণ করবে।

মূলত, নৈতিক মূল্যবোধের সহিত কিভাবে একজন শিশুকে বড় করা যায়- আমরা সে বিষয়েই কথা বলব। এদিকে বেশিরভাগ লোকেরা ধরে নিয়েছে যে, শাস্তিই মানুষকে সঠিক কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। তাই আমরা যদি আমাদের বাচ্চাদের শাস্তি না দিই, তবে তারা ভুল কাজ করে বড় হবে। এটি মানব প্রকৃতির একটি বর্ণহীন দৃষ্টিভঙ্গি। বরং এটি ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বহু গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে বাচ্চাদের শাস্তি দিলে তারা ইতিবাচক মনোভাব থেকে পিছিয়ে পড়ে। বরং তারা নেতিবাচক মনোভাবের দিকে প্রবল আকৃষ্ট হয়। যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য ঝুকি বয়ে আনে।

শাস্তি বনাম প্যারেন্টিং টেকনিক

চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক, বাচ্চাদের শাস্তি দিলে তার পরিণতি কি হতে পারে আর কি তার প্রতিকার? অসাধারণ কিছু প্যারেন্টিং টিপস আপনাদের সামনে তুলে ধরব:

খারাপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করা

যেসমস্ত খারাপ আচরণ করার জন্য বাচ্চাকে আপনি শাস্তি দিচ্ছেন বরং সে না শুধরিয়ে সে সমস্ত খারাপ আচরণের প্রতি আরো বেশি ঝুকে পড়ে। পাশাপাশি এটি তাকে আরও স্বকেন্দ্রিক এবং কম সহানুভূতিশীল করে তোলে। বস্তুত, সে জানেনই না তার করা খারাপ আচরণটির পরিণতি কি?

ধরেন, কোনো কারণে আপনি রেগে গেলেন। যার ফলে স্ত্রীকে শুরু করলেন বেধরক মার, সাথে যাচ্ছেতাই গালি। এ ঘটনা আপনি প্রায়ই বাড়িতে ঘটান। কিন্তু পাশে যে আপনার ৪-৫ বছর বয়সী শিশুটি আছে সেদিকে আপনার কোনো ভ্রুক্ষেপই থাকে না। এটা হয়তো জেনে থাকবেন, শিশুরা অনুকরণ প্রিয়।

সুতরাং আপনার দেওয়া প্রত্যেকটি গালি সে মনে রাখে। কিন্তু সে যখন না বুঝে আপনাকে “শালা, কুত্তার বাচ্চা” ইত্যাদি বলে গালি দেয়, তখন আপনি ভাবলেন যে ‘এবার একে শাসন করতে হবে। নয়তো বড় বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।” শুরু করলেন বেধরক মাইর। ব্যাস কি হলো “ইটটি মেরে পাটকেলটি খেতে হলো।”

যাইহোক, সেদিন শাসন করার পর আপনি আবারো স্ত্রীকে বাচ্চার সামনে অহেতুক গালাগালি করলেন। তাহলে মনে রাখবেন, আপনার বাচ্চার খারাপ আচরণটি পুনরাবৃত্তি করার সম্ভাবনা ১০০%।

স্মার্ট টেকনিক- এক্ষেত্রে আপনি তার সামনে ঐ পরিস্থিতির ভালো ও খারাপ দুটো দিকই তুলে ধরতে পারেন। তাহলে সে নিজে থেকেই নিজেকে শুধরিয়ে নিবে। বাচ্চাদের সামনে কখনো গালিগালাজ বা কোনো খারাপ আচরণ করবেন না। তাদের নীতি গল্প শোনাবেন বা তার সামনে আপনার স্ত্রীকে গল্প শোনাবেন, দেখবেন মনযোগ দিয়ে শুনে নিজে উপলদ্ধি করতে পারবে। আর একবার নিজে থেকে বোঝা বা উপলদ্ধি করতে পারলে সারা জীবন তা টেকসই থাকবে।

নিজেকে একজন খারাপ ব্যক্তি ভাবা

শাস্তি একটা শিশুর মন মানসিকতা নষ্ট করে। তার সুস্থ চিন্তাধারায় বাধা ঘটায়। বারংবার শাস্তি দেওয়ার কারণে সে নিজেকে একজন খারাপ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাই খারাপ আচরণটির পুনরাবৃত্তি করার সম্ভাবনা তার খুব বেশি।

ধরেন, বিনা কারণে আমরা সবাই একটা ১০-১২ বছর বয়সী শিশুকে ‘চোরের ব্যাটা চোর’ বলে ডাকি। তার সমবয়সী বন্ধুবান্ধব, এমনকি বড়রাও একই ভাবে তাকে তাচ্ছিল্য করে। এ ঘটনা একদিন নয় বরং তার সাথে প্রত্যেকদিন ঘটে। এতে শিশুটি ধীরে ধীরে মনের শক্তি হারিয়ে ফেলে। হাজারো তাচ্ছিল্যের মাঝে সে নিজেকে একজন খারাপ ব্যক্তি বিবেচনা করে। সে চিন্তা করে ‘সবাই যেহেতু আমাকে খারাপ বলে তাহলে হয়তো আমি খারাপ।’ দেখি খারাপ কাজটাই করি। এভাবে সে ভয়ংকর পথে পা বাড়ায়।

স্মার্ট টেকনিক- শিশুকে শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অযথা কাউকে তাচ্ছিল্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একজন লোক খারাপ তাই বলে তার ছেলেও খারাপ হবে। এমনটা ভাবা মূর্খতার পরিচয়।

মিথ্যা বলার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া

শাস্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় হলো ‘ভবিষ্যতে লুকিয়ে থাকা।’ অর্থাৎ অপরাধের পর ধরা খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যা বলার মাধ্যমে এড়ানো। সুতরাং শাস্তি শিশুদের মাঝে অসততা বাড়ায়।

ধরেন, আপনি ৪-৫ বছর বয়সী একটা বাচ্চাকে ছোট ছোট সব ভুলের জন্যও শাস্তি দেন। অহেতুক মারধর করেন। যার ফলে সে এটা ভেবে নেয় যে, কোনো ভুল হলে বাবা আমাকে মারবেই। আর শিশুরা শাস্তিকে প্রচণ্ড ভয় পায়। ফলে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য সে মিথ্যা বলা শুরু করে। হঠাৎ একদিন ভুলবশত তার হাত থেকে আপনার পছন্দের ঘড়িটি পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায়। আপনি এসে জিঙ্গাসা করলেন, ঘড়িটি কে ভেঙেছে। সে বলল, বাবা বিড়ালটা ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলেছে। আর আপনিও বিষয়টাতে সম্মতি দিলেন। এতে সে বুঝে ফেলল মিথ্যা বললে শাস্তি থেকে বাঁচা যায়।

আর এভাবেই শুরু হয় তার মিথ্যা বলা।

স্মার্ট টেকনিক- সন্তানের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করলে এমনটা কখনোই হতো না। বরং সে আপনাকে আদর করে বলতো, বাবা আমি তোমার পছন্দের ঘড়িটা ভুলবশত ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করো। আর আপনি আদর করে তাকে একটি চুমো দিয়ে বলতেন, ইটস ওকে, মামনি। তবে একটু সাবধানে ধরিও। তাহলে শিশুটি আর কখনোই আপনাকে মিথ্যা বলার সাহস পেত না। সন্তানদের সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করুন।

নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়

শাস্তিকে বাচ্চারা সবসময় অন্যায় বিবেচনা করে। এটি বাচ্চাদের ভালো কিছু শেখায় না। বরং এটি তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করা শেখায়। যা বাচ্চাদের মধ্যে নৈতিক ধারণা জন্মাতে বাধা প্রদান করে।

ধরেন, যেখানে আপনার শরীরে আঘাত করলে আপনি সহ্য করতে পারেন না, সেখানে একটা বাচ্চার শরীরে আঘাত করলে সে কিভাবে সহ্য করবে। হ্যাঁ, বাচ্চাদের সহ্য ক্ষমতা অনেক কম। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আপনার মেয়ে কাঁচের সুন্দর গ্লাসটি ভেঙে ফেলল।

আর আপনি তাকে চট করে একটা তাপ্পর মারলেন। কিন্তু আপনি এটাতো জানেন, সে ছোট মানুষ। ভুলবশত, ভেঙে গেছে। কিন্তু না, আপনার রাগের সামনে ছোট বড় সবাই সমান। এসব কাণ্ড আপনি প্রায়ই করে থাকেন।

তবে ভেবে নিন, শিশুটি আপনাকে একজন কঠোরপন্থী অভিভাবক হিসেবেই বিবেচনা করবে। আর সে এটাও ভাববে, বড়রা শুধু শাস্তিই দিতে পারে, আদর করতে পারে না।

স্মার্ট টেকনিক- আপনার উচিত ছিল ‘গ্লাসটি ভাঙ্গার সাথে সাথে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নেওয়া। তার কোনো শারীরিক ক্ষতি হয়েছে কিনা তার খোজখবর নেওয়া। তাকে এটা বলা, মামনি একটু কাঁচের গ্লাস একটু সাবধানে ধরতে হয়।

নতুবা ভেঙে গিয়ে তোমার শরীরে ক্ষত হতে পারে। দেখতে আর কোনো দিন আপনাকে বকাবকি করতে লাগত না। সে বিষয়টা একেবারে সহজভাবে শিখে যেত। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য আপনার উপর নির্ভর করছে।

পিতামাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া

শাস্তি – হ্যাঁ, সময়সীমাও – সন্তানের সাথে আমাদের সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়। সন্তানের বিভিন্ন ভালো কাজে পিতামাতা সন্তুষ্ট হবে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ভালো খারাপ সব কাজেই আপনি তার ভুল ধরেন, তাকে নানাবিধ কথা শোনান। এভাবে প্রতিনিয়ত শাস্তি দেওয়ার ফলে সন্তাদের সাথে পিতামাতার সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। আর শাস্তি যতই বাড়ে, সম্পর্ক ততই নষ্ট হয়। আর সম্পর্ক যত নষ্ট হয়, সন্তানের আচরণ ততই খারাপ হতে থাকে।

ধরেন, আপনার ১৩-১৪ বছর বয়সী শিশুটি খারাপ সংগ পেয়ে সিগারেট খেতে শুরু করেছে। লোক মারফত আপনি জানতে পারলেন যে ঘটনা সত্য। আর এ ঘটনার জন্য আপনি তাকে প্রতিনিয়ত টর্চার করা শুর করলেন। দেখা যাচ্ছে, সে বিষয়টি বুঝতে পেরে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও আপনি টর্চার করা ছাড়লেন না। এতে আপনার প্রতি তার একটি বিরূপ মনোভাব তৈরি হবে। যার ফলে তার সাথে আপনার সম্পর্কের দূরুত্ব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে।

স্মার্ট টেকনিক- আপনি যদি তাকে মারধর না করে সিগারেট খাওয়ার কুফল ও রোগ ব্যাধি সম্পর্কে জানাতেন তবে সে নিজে থেকেই শুধরিয়ে নিতো। আর মনে রাখবেন এক কথা বার বার বলা কেউ পছন্দ করে না। না আপনি, না আমি। তাই তার পরিবর্তন হয়েছে কিনা এ বিষয়টি আগে খেয়াল করুন।

সামাজিকীকরণে বিরূপ প্রভাব

এটা আমরা সবাই জানি, একজন শিশু জন্মের পর তার আশেপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটায়। এটাকে বলে সামাজিকীকরণ। কিন্তু একজন শিশুকে শাস্তি দেওয়া হলে এই প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে। বরং সে ভালো জিনিসগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে খারাপ জিনিসগুলোর দিকে ঝুকে পড়ে। শিশুটি না বুঝে ধীরে ধীরে আরো বেশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

আপনার হয়তো জানা থাকতে পারে- পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমবয়সী বন্ধু, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এসব জিনিসগুলো সামাজিকীকরণের অংশ। সমাজে চলতে গেলে ছোট খাটো ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক।

স্মার্ট টেকনিক- ছোট ছোট ভুলের জন্য আপনার সন্তানকে শাস্তি না দিয়ে তাকে ভালোবাসা দিন। তাকে এটা শেখান- ভুল হলে কিভাবে অন্যের কাছে মাফ চাইতে হয়, কিভাবে সত্য বলতে হয়, কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়, কিভাবে অন্যের খারাপ জিনিসগুলো বর্জন করে ভালো জিনিসগুলো গ্রহণ করা যায় ইত্যাদি।

আবেগের মরণ

জন্মের ১ বছরের মধ্যেই শিশুর মধ্যে আবেগ এর সঞ্চার ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ, খেয়াল করে দেখুন তো- ১ বছর বয়সী একটা শিশুর সামনে আপনি যখন একটু মজাদারভাবে অঙ্গাভিনয় করেন তখন শিশুটি হেসে উঠে। আবার তার পাশে অন্য একটি শিশু কান্না করলে সেও কেঁদে উঠে। আর একটি বড় বিষয় হলো, যে মানুষটি তাকে বেশি বেশি আদর করে, তার আবেগগুলি বুঝে তার সাথে শিশুটি থাকতে বেশি পছন্দ করে। এমনি অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।

কোথাও আঘাত পেলে শিশুরা চায় বাবা মা তাকে আদর করুক, তার সেফটি হোক। প্রতিটি শিশুর বৈশিষ্ট্য এটি। কিন্তু তা না করে আপনি তাকে মারেন, তাকে গালিগালাজ করেন। এভাবেই তার আবেগের মরণ ঘটে। আর এই ছোট্ট বয়স থেকেই আপনি যদি তাকে কড়া শাসনের মধ্যে রাখেন, তার ছোট্ট ছোট্ট ভুল গুলোর জন্য তাকে শাস্তি দেন তাহলে শিশুটির মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সে আপনাকে একজন খারাপ লোক ভেবে নেয় এবং বারংবার দুর্ব্যবহারের পুনরাবৃত্তি ঘটায়।

স্মার্ট টেকনিক- আঘাত প্রাপ্ত হলে সন্তানকে না মেরে তার সেফটি হোন। তাকে বোঝান, এটা তোমার জন্য বিপদজনক। দেখবেন, সে ঠিকই আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। সন্তান লালন পালন ভালো ভাবে করতে হলে আপনার আবেগের সাথে তার আবেগ মিশে যাবে। আপনি যেন আপনার বাচ্চার মুখ দেখে বুঝতে পারেন তার কি চাই, তেমনি আপনার বাচ্চাও যেন তার মায়ের মুখ দেখে তা বুঝে।

অপরাধবোধের সৃষ্টি

একটা ঘটনা বলি। একটা ছোট্ট শিশু, বয়স আনুমানিক ৮ বছর হবে। পেটের খিধায় দোকান থেকে দু তিনটা রুটি চুরি করে। এতে দোকানদার তাকে হাতেনাতে ধরা পায় এবং তাকে চোর বলে সম্বোধন করে। এতে শিশুটি মন খারাপ করলেও নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করে।

কিন্তু হঠাত ঐ দোকানে আবারো চুরি হয়। কিন্তু এবার দোকানদার চোরকে ধরতে পারেনি। ইতোমধ্যে ঐ ছেলেটি দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এবং দোকানদার পুণরায় তাকে চোর বলে সম্বোধন করে। এভাবে দোকানদার তাকে চোরের সিলমোহর দিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কোনো চুরির ঘটনা ঘটলে তার নাম আসতোই এবং শিশুটি চুরি না করেও গণপিটুনি খেত।

এভাবে শিশুটি ধীরে ধীরে ভয়ংকর হয়ে উঠে। আশেপাশের মানুষকে নিজের শত্রু ভাবতে শুরু করে। পরবর্তীতে শিশুটি অপরাধ জগতের সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে।

স্মার্ট টেকনিক- ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এক ভুলের জন্য বারংবার শাস্তি দেওয়াটা অপরাধ। এটা হিতের বিপরীত। মানুষকে সংশোধনের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।

আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা

শাস্তি দেওয়ার ফলে বাচ্চারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠে। কি, বুঝলেন না তো? আসলে ব্যাপারটা এরকম – ধরেন, আপনি বাচ্চাকে একটু ভিন্নভাবে লালনপালন করতে চান। ডিসিশন অনুসারে অন্য বাচ্চাদের সাথে তাকে মেলামেশাও করতে দেন না। বাইরের পরিবেশ এবং বন্ধু-বান্ধব থেকে তাকে বিরত রেখে সম্পূর্ণ গৃহবন্দী অবস্থায় তাকে বড় করছেন।

জানেন কী – এই ডিসিশনটার জন্য আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা অভিভাবকের পরিচয় দিলেন। গৃহবন্দি অবস্থায় শিশুটি গুটিকয়েক লোক ব্যতিত অন্য কারো সাথে মিশতে পারে না।

তাই বাইরের পরিবেশ কেমন, অন্য লোকদের আচরণ কেমন, দুঃখ কি, আনন্দ কি, কাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত – এসব বিষয়ে তার কোনো ধারণাই জন্মায় না। বরং সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সব সময়। অর্থাৎ আমরা যেটা গ্রাম্য ভাষায় বলি, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম।’ এমন হীন মানসিকতা নিয়ে সে বড় হয়। শিশুকে শাসন করতে গিয়ে যেন হিতে বিপরীত হয়ে না যায়।

স্মার্ট টেকনিক- বাচ্চার মানসিক বিকাশে আত্মকেন্দ্রিকতা যদি ছোট থেকে গড়ে ওঠে তাহলে বৃদ্ধ বয়সে আপনার থাকার জায়গা হতে পারে বৃদ্ধাশ্রম বা নিঃসঙ্গ জীবন। তাই ছোট থেকে তাকে শেয়ারিং শেখান, কিভাবে অন্যকে দিয়ে খেতে হয় তার আনন্দ ভোগ করার জায়গা করে দেন।

অসভ্যতার পরিচয় দেওয়া

বাচ্চাদের শাস্তি দিলে তাদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়। এতে তারা অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা না করে বরং তাদের ভুলত্রুটি ধরে বেড়ায়। এমনকি খারাপ মন্তব্য করতেও দ্বিধাবোধ করে না।

স্মার্ট টেকনিক- শিশুদের সৃষ্টিশীল হতে শেখান। কিভাবে অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা করতে হয় তা শেখান? অন্য বাচ্চার সাথে তুলনা করবেন না, তুলনা কেউ পছন্দ করে না। তাই প্রশংসা করুন সবার আলাদা ভাবে এবং মিষ্টি সুরে।

স্ব-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার বিনাশ

শাস্তি শিশুদের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন ঘটায়। কি, বুঝলেন নাতো! শুনুন তাহলে, একজন শিশু ছোট থেকে ধীরে ধীরে যখন বড় হয় তখন সে নতুন নতুন জিনিস শেখে ও নতুন নতুন জিনিস করে। এতে বেশ কিছু ভুলভ্রান্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই সামান্য ভুলত্রুটির জন্য আপনি তাকে বেধরক শাস্তি দেন। এখন আপনি ভাবছেন, শাস্তি দিলাম। যাক, এখন থেকে আর এ কাজ করবে না।

আমি বলব, আপনি চরম একটি ভুল কাজ করলেন। এর জন্য তার করা ভুলত্রুটি গুলো থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পেতে পারেন। কিন্তু এই শাস্তি দেওয়ার ফলে শিশুটির একটি বড় ক্ষতি আপনি করে ফেললেন। আর তা হলো ‘নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।’ হ্যাঁ, নিয়মিত শাস্তি দেওয়ার ফলে শিশুদের স্ব-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। যার ফলে শিশুরা যে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য পিতামাতা নির্ভর হয়ে পড়ে। যা তার পরবর্তি জীবনে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

স্মার্ট টেকনিক- শিশুটি যখন ভুলটি করেই ফেলেছে, তখন আপনার উচিত ছিল তাকে সঠিক জিনিসটি জানানো। এমনকি ঐ ভুলটির ভালো দিক ও খারাপ দিক তার সামনে তুলে ধরা। যাতে সে তার করা ভুলটির জন্য অনুশোচনা করতে পারে। এভাবে সে নিজে নিজেই সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারত। সন্তান খুব ছোট হলে তাকে বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে হবে।

লক্ষ্য পূরণে বাধা

শাস্তি শিশুদের লক্ষ পূরণে বাধা প্রদান করে। ধরেন, ১১-১২ বছরের একজন শিশু পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে। কিন্তু আপনি চান সে ক্রিকেট না খেলে বরং ঐ সময়টাও পড়ালেখা করুক। এতে তার রেজাল্ট ভালো হবে। তাই জোরপূর্বক তাকে আপনি পড়ালেখায় বাধ্য করালেন। আপনি ভাবছেন, হম্ম এবার দেখি এ প্লাস কোথায় যায়?

কিন্তু সত্যটা কি জানেন? আপনি নিজের স্বপ্ন পূরণে তার উপর জোর খাটালেন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণে আবার আপনি নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। এবার নিশ্চয়ই আপনার মাথা ঘুরছে। কেননা, আমি নিশ্চিত এ বোধবাক্যটি আপনার মাথায় একেবারেই ঢুকেনি।

ঠিক আছে, আমি বোঝাচ্ছি। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ফ্রেশ হয়ে পড়াশোনা, এরপর টিউশন, তারপর টানা ৫-৬ ঘন্টা স্কুল, বিকেলে আবার একটা টিউশন এবং রাতে নিজের পড়াশোনা। পুরাই রোবট বানাই ফেলছেন। কি একটা অবস্থা? এই রেজাল্ট রেজাল্ট করে আপনি তার জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলতেছেন।

আসলে শিশুদের প্রধান দায়িত্ব হলো পড়াশোনা। এটা ঠিক আছে। তাই বলে যে সারাদিন রাত পড়াশোনাই করবে এমনটা নয়। একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব হলো তাকে সঠিকভাবে লালন পালন করা, তার সামাজিকীকরণে অংশ নেওয়া, তার শারীরিক গঠন দেখা, তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটানো ইত্যাদি।

সারাদিন একঘেয়েমি টিউশন আর ক্লাস করার পর বোরিং লাগাটাই স্বাভাবিক। আর এই বোরিংনেস দূর করতে সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো খেলাধুলা। খেললে শরীর থেকে ঘাম ঝরে, শরীরে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়, মস্তিষ্ক দ্রুত কর্মক্ষম হয়। উপরন্ত, খেলাধুলার পর নিজের সুবিধার্তে গোসল করলে পরবর্তী কাজের জন্য মস্তিষ্ক নতুন ভাবে কাজ শুরু করে। তাই আপনার সন্তানকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খেলতে দিন।

স্মার্ট টেকনিক- খেলাধুলা ক্লান্তি দূর করার একটি উত্তম উপায়। নিয়মিত খেললে শিশুদের শারীরিক গঠন ঠিক থাকে এবং দ্রুত বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। তবে কোনো বাচ্চাদের যদি পড়াশোনার থেকে খেলাধুলার প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকে তবে তাকে বিভিন্নভাবে বোঝাতে হবে। আপনি তার সামনে দুটো অপশন রাখতে পারেন। এইভাবে – তুমি ৪ টার সময় বই নিয়ে বসবে নাকি এখন খেলাধুলা করে ৬ টায় বই নিয়ে বসবে। দেখবেন, সে আপনাকে একটি সঠিক মন্তব্যই দিবে।

কাজের প্রতি অনাগ্রহী করে তোলা

শাস্তি শিশুদের কাজের প্রতি অনাগ্রহী করে তোলে। ধরেন, আপনার বাচ্চাটি পড়ালেখার পাশাপাশি ছবি আকতে পছন্দ করে। কিন্তু আপনি তার ছবি আঁকাকে মূল্যায়ন করেন না। বরং একটি বাজে কাজ বলে তাচ্ছিল্যের সুরে মন্তব্য করেন। যদি আপনি তার প্রতি এমন আচরণ করতে থাকেন তাহলে শিশুটি আর নিজে থেকে কখনো আর নতুন জিনিস শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করবে না। তার সৃজনশীলতা ও নতুন জিনিসকে জানার আগ্রহ একেবারেই দমে যাবে।

স্মার্ট টেকনিক- শিশুদের ভালো কাজের বেশি বেশি প্রশংসা করুন। তাকে আরো ভালো করার উৎসাহ দিন। নতুন নতুন চিন্তা করার ও নতুন নতুন কাজ করার অনুপ্রেরণা দিন। মাঠে নিয়ে তার সাথে খেলা করুন বা তাকে খেলতে দিন তার মত করে।

শাস্তি কখনোই শিশুদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না। শাস্তির ফলে আপেক্ষিক লাভ হলেও ভবিষ্যতে এর কুফল অনেক। আসলে শিশুদের মানসিক সমস্যা বা রোগ কিন্তু ছোটবেলা থেকেই একটু করে জন্ম নিতে থাকে। যার বড় প্রভাব বিস্তার করে শাস্তি বা বাচ্চাকে মেরে শাসন করা।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কিছু পিতামাতা তাদের সন্তানকে শাস্তি দিয়ে একটা কঠিন রুটিন এর মাধ্যেমে বড় করেছেন। যার ফলে ঐ সমস্ত শিশু তাদের সমবয়সীদের তুলনায় নৈতিকভাবে কম বিকাশ করেছিল। কিন্তু যে সমস্ত পিতামাতা তাদের সন্তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন ঠিক রেখে একটা সহজ রুটিনে ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন সে সমস্ত সন্তানদের বুদ্ধির বিকাশ বেশি হয়েছিল।

তাইতো আলফি কোহন বলেছেন -“Having learned to do exactly what they’re told in order to avoid losing their parent’s love, they tended to just apply rules in a rigid, one-size-fits-all fashion.”

তাদের যা বলা হয়েছিল ঠিক তা করতে শিখতে পেরে তারা কেবল কঠোর, এক-আকারের-ফিট-ফ্যাশনে নিয়ম প্রয়োগ করার ঝোঁক রেখেছিল,” অ্যালফি কোহন বলেছেন।
শিশুকে বোঝানোর কার্যকরী উপায়

সামগ্রিকভাবে নেওয়া, গবেষণার এই সংস্থাটি সুপারিশ করে, যে শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে (সময়সীমা ও পরিণতি সহ) তারা আরও বেশি খারাপ আচরণ প্রদর্শন করে। যেসব বাচ্চারা খারাপ আচরণ করে তাদের যে সব সময়ই শাস্তি দেওয়া হয় এমনটা নয়, তবে শাস্তি প্রাপ্ত বাচ্চারা বেশি বেশি খারাপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করে।

শিশুকে শাস্তি দিবেন নাকি ভালোবাসা

যদি দেখেন যে আপনার সন্তান এমন একটা কাজ করছে যা অনেক বোঝানোর পরেও কাজ হচ্ছে না, এক্ষেত্রে আপনাকে একটি কার্যকরী টিপস বলি- প্রথমত মা হিসেবে আপনাকে যে সে অনেক বেশি ভালোবাসে তা নিশ্চিত করুন। এজন্য আদর, মায়া, মমতা আর ভালোবাসা এমন ভাবে দিন যেন সে আপনাকে ছাড়া আর কিছুই না বোঝে।

এমতবস্থায়, তার কোন খারাপ কাজে আপনি মন খারাপ করে চুপচাপ থাকুন, সে যেন বুঝতে পারে যে মায়ের অনেক মন খারাপ, আর তার জন্য সে দায়ী। দেখবেন, আপনার এই মন খারাপ করে থাকা মুখের দিকে সে আর তাকাতে না পেরে ঐ খারাপ কাজটা করা থেকে বিরত থাকবে। আমার মা ঠিক এই পদ্ধতি দিয়ে আমাকে বড় করেছে, বলতে গেলে এটা এক ধরনের ইমোশনাল ব্লাকমেল। তবে বাচ্চার ইমোশন নিয়ে বেশি খেলবেন না, যতটা পারেন গল্পের মাধ্যমে শেখান আর দু একবার ভুলের জন্য তাকে মিষ্টি ভাবে সতর্ক করেন।

যে বিষয়টা একবার বোধ বা উপলদ্ধি হয় সেটা আর কখনো হারায় না। কিন্তু জোর করে ধমক দিয়ে সেটা বেশিদিন টিকে না, কারণ নিষিদ্ধ কাজের প্রতি মানুষের আকর্ষণ থাকে বেশি আর বাচ্চাদের তো আরো বেশি। তাই না না করে আর ভয় দেখিয়ে ঐ কাজের প্রতি তার নিষিদ্ধ আগ্রহ তৈরী করবেন না। বাবা মা হিসেবে সর্বোচ্চ ধর্য আর সহনশীল হতে হবে আপনাকে। এজন্য বাচ্চা নেয়ার আগে প্যারেন্টিং কোর্স করা উচিত প্রত্যেক পিতা মাতাকে। তাহলে মারাত্মক ভুল গুলো আর হবে না এবং আদর্শ সন্তানের বাবা মা হিসেবে নিজেকে গর্বিত করতে পারবেন।

প্রশ্ন – উত্তর পর্ব

বাচ্চাদের মারলে কি হয়?

শিশুর মানসিক সমস্যার মূল কারণ এই গালি দেয়া বা বকা দেয়া কিংবা শাস্তি দেয়া। আপনি হয়তো ভাবছেন গালি দিয়ে ভয় দেখালে সে আর সেটা করবে না। কিন্তু আপনার ধারণা ভুল, তাকে আপনি সামান্য সময়ের জন্য বিরত রাখলেন। সে সুযোগ পেলেই সেটা করবে যে কোন সময়ে।

তাছাড়া শিশু রাগি, জেদী, বদমেজাজি, খারাপ স্বভাবের হয় এই ধমক খেয়ে। কারণ তার আত্মসম্মান যখন থাকে না তখন সে আর কোন কিছুর ভয় করে না। তাই আপনার সন্তানকে মূল্যায়ন করুন, পরামর্শ নিন, বাহবা দিন। আর নিষেধ করা সত্বেও কোন কাজ করলে তার জন্য আপনি বুঝিয়ে বলুন বা নিজে অভিমান করুন। বাচ্চাকে উপলদ্ধি দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করুন যেটা তার সারা জীবন কাজে লাগবে।


সন্তান অবাধ্য হলে কি করবেন?

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে- মা গুনে ছা, অর্থাৎ পরিবারের দেখে বাচ্চারা আচরণ শিখে। আপনি যদি একজন রাগী মানুষ হোন বা জেদি হোন তাহলে আপনার বাচ্চাও আপনাকে দেখে তাই শিখবে। কারণ বাচ্চারা অনুকরণপ্রিয়। সে আপনার কথা না শুনলেও আপনাকে সে অনুসরণ করে। তাই নিজেকে আগে শুধরে নিন, নইলে যত যাই করেন কোন কাজে আসবে না। সন্তান লালন পালনে আপনাকে অনেক স্মার্ট আর ধর্যশীল হতে হবে।


বাচ্চার রাগ কমানোর উপায় কি?

নিজেকে প্রকাশ করতে না পারলেই শিশুরা রেগে যায়। আবার বড়রা ছোট বাচ্চাদের রাগিয়ে মজা পায়। বাবা তার মাকে বাচ্চার সামনে মারছে, বা মা কাজের লোককে বাচ্চার সামনে মারছে, কিম্বা বাবা/মা বাচ্চাকে সামান্য কারণেই মারছে। সে শিখছে “নিজের মতের বিরুদ্ধে কিছু হলেই মারতে হয়”! তাই আগে রাগের কারন অনুসন্ধান করুন। নিজেকে শিশুর জায়গায় কল্পনা করুন। কখন আপনার রাগের চোটে অন্যকে মারতে ইচ্ছা করে, অথচ নিজেকে কনট্রোল করেন? আপনি কথা বলতে পারছেন, তাই সেটা প্রকাশ করতে পারছেন। কিন্তু সে পারছে না বলেই হয়তো মারামারি করছে।

যদি সে মারামারি করে তাহলে তাকে আলাদা করে ডেকে নিন, বসে কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা হওয়ার সময় দিন। তারপর তাকে বলুন সে অন্য বাচ্চাকে আঘাত না করে খেলাটা এনজয় করতে প্রস্তুত থাকলে আপনি তাকে খেলতে দিবেন। এভাবে যেকোন বিষয়ে তার রাগ কমানোর জন্য তাকে শর্ত দিন, কিন্তু ধমক বা শাস্তি দিবেন না। ধমক দিয়ে কিছু সময়ের জন্য তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, বাকি সময়টাতে আড়ালে সে ওটাই করবে। তাই ঠিক করেন আপনি কি করতে ইচ্ছুক?


শিশুর জিদ কমানোর উপায় কি?

শিশুর সাথে তর্কে যাবেন না। তাকে এমন প্রশ্ন করবেন না, “তোমার কেমন লাগত যদি সে তোমাকে মারতো/কামড় দিত”? শিশুরা নিজেকে অন্য আরেকজনের জায়গায় বসিয়ে তার অনুভূতি কল্পনা করার মতো দক্ষতা এখনও অর্জন করেনি আর তাই এর মাধ্যমে তাদের আচরণের পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু তারা একটা অন্যায় কাজের ফলাফল কি হয় তা বুঝতে সক্ষম। আর জিদ, অবুঝ, পাগলামি এগুলো শিশুদের মানায়, তারা করবে নাতো কে করবে? এতটুকু গ্রহণ করতে শিখুন, তারপর তার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিন।

যেমন- সে একটি ভিডিও গেমস আবদার করল, তাহলে সাথে সাথে সেটা কিনে দিবেন না। তাকে এটার জন্য কিছু শর্ত দিন, বলুন যে তুমি যদি এবার ইংরেজিতে ১০০ মধ্যে ৯০ পাও তাহলে সেদিনই কিনে দিব। তারপর সে যদি ঐ নম্বর পায় তাহলে তাকে সেটা কিনে দিন আর বলুন যে এই নম্বর ধরে রাখতে না পারলে কিন্তু এটি আমি নিয়ে নিব। এভাবে প্রয়োজন দেখিয়ে তাকে কোন কিছু অর্জনের জন্য আগ্রহী করে তুলুন।


শিশু দুষ্টুমি করলে কী করবেন?

আচ্ছা বাচ্চারা দুষ্টুমি করবে না তো কে করবে? আপনার বাচ্চা ভীষণ চঞ্চল, ভীষণ দুষ্টু এটা আপনার চিন্তার কারণ কিন্তু একই সাথে সে কিন্তু জিনিয়াস আর চালাক। কারণ এসব বাচ্চারা জীবন উপভোগ করতে পারে, হতাশা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারে খুব দ্রুত। আপনি সফল মানুষের জীবনী পড়লে দেখবেন যে প্রায় সবাই ছোটবেলায় অনেক দুষ্টু ছিল।

তাই বাচ্চা যদি মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি করে অন্যের ক্ষতি করে সেক্ষেত্রে আপনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাও ঠাণ্ডাভাবে। যেমন- সে যদি কারো ক্ষতি করে বসে তাহলে আপনি মন খারাপ করে থাকবেন। যখন বলবে যে- মা তোমার কি হইছে? তখন আপনি বলবেন যে তুমি যার ক্ষতি করছ তার জন্য আমার মন খারাপ। কারো ক্ষতি হলে আমার মন খারাপ হয়। দেখবেন সে আর সেটা করবে না, আর নিজেও উপলদ্ধি করবে যে অন্যের মন খারাপ হলে নিজেরও খারাপ লাগা দরকার।


শিশুদের বোঝানোর উপায় কি?

আমরা অনেক সময় বোঝানোর জন্য শিশুদের অন্যের সাথে তুলনা দেই, তাকে ছোট করি। কিন্তু ভুলেও এটা করবেন না। কোন শিশুই তুলনা পছন্দ করে না। সবার আলাদা একটা পরিচয় আছে। যার সাথে তুলনা করবেন সে তার প্রতিদন্দী হয়ে উঠবে। তাকে হিংসা করা শুরু করবে, অহংকারী হবে। তাই বাচ্চাকে বোঝানোর জন্য গল্প বা ঘটনা শোনাবেন।

যেমন- মিথ্যে বললে কি হয় তার ভয়াবহ কোন ঘটনা আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে আলোচনা করেন যাতে সেও শুনতে পায়। দেখবেন আপনার শিশু মনযোগ দিয়ে তা শুনবে আর নিজে থেকে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করবে বিষয়টায় ভয়াবহতা সম্পর্কে। বাচ্চাদের বিচার বিশ্লেষণ খুবই ভালো, সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

উপসংহার

শাস্তি যদি আমাদের শিশুকে সমস্ত ভুল পাঠ শিক্ষা দেয়, তবে কেন শিশুকে শেখানোর জন্য আপনি শাস্তির পন্থা অবলম্বন করবেন? তার সামনে স্নেহপূর্ণ পথ প্রদর্শন করুণ। যার মধ্যে সহানুভূতি, ভালোবাসা, আবেগ ইত্যাদি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *