শিশুর খাবারে অরুচি – কিভাবে শিশুকে খাবারের প্রতি উৎসাহী করে তুলবেন

শিশুর খাবারে অরুচি – কিভাবে শিশুকে খাবারের প্রতি উৎসাহী করে তুলবেন: দিন দিন শিশুর ক্রমশ স্বাস্থ্যহানি দেখে আপনি টেনশন এ পড়ে গেছেন। ভাবছেন, আপনার আদরের বেবিটা আগের মত আর খাচ্ছে না, রোগাটে হয়ে যাচ্ছে। মুখের সামনে খাবার ধরলে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে এটাও বলে “এই খাবার আমার পছন্দ না। আমি এটা খাব না।”

আবার অনেক অভিভাবককেই দেখা যায়, খাবারের থালা নিয়ে বাচ্চার পিছনে রীতিমতো দৌড়াতে। অভিযোগ একটাই, তাদের বাচ্চা খেতে চায় না।

এসব দেখে মহা টেনশনে পড়ে গেলেন। এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মায়ের শালদুধ হবে নবজাতকের প্রথম খাবার। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শালদুধ (গাঢ় এবং হলদেটে) দিতে পারলে শিশু মৃত্যুর হার ৩৭ শতাংশ কমে যায়।

যাই হোক, কেন শিশু খেতে চায় না, কী করলে সে ঠিকমত খাবে, কিভাবে বাচ্চাকে খাওয়ানো দরকার – এসব বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। নিচের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। আপনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।

শিশু কেন খেতে চায় না ?

মূলত শিশুদের না খাওয়ার অন্যতম কারণ হলো অনিয়ম। আর এর জন্য বেশিরভাগ ডাক্তাররাই বাবা মায়েদের অসচেতনতাকে দায়ী করেন। আসলে তারা এটা করেন না জেনে। আবার অনেকক্ষেত্রে শিশুর আবদার মেটাতে গিয়েও কিছু বিপত্তি দেখা দেয়।

বাইরের লোভনীয় ও মুখরোচক খাবারগুলোতে শিশুকে অভ্যস্ত করে তুললে ঘরে তৈরি খাবারের প্রতি তাদের চাহিদা কমে যায়, খাদ্যাভাস নষ্ট হয়। অনেক অভিভাবক আবার ভাত খেতে না খেতেই শিশুকে বিস্কুট, চকলেট, রুটি ইত্যাদি খাওয়ান। আবার অনেকে দীর্ঘসময় ধরে খাওয়ান – এটা লক্ষ করেন না যে শিশুর পেটে খিদে আছে না নেই।

শিশু কাঁদলেও অনেকে মনে করেন শিশুর খিদে পেয়েছে। অথচ শিশু অন্য কারণেও কাঁদতে পারে। বাচ্চা একবেলা ঠিকমতো খায়নি বলে অনেকে ব্যাকুল হয়ে যান। আবার দেখা যায়, সকাল ৭ টায় পেট পুরে খাওয়াতে পারেননি বলে সকাল ৮ টায় পুনরায় খাওয়ানোর জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন।

আপনার এসব কর্মকাণ্ডই শিশুর জন্য ক্ষতিকর। একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন, পূর্বের খাবার হজম হলেই শিশুর খিদে পায়। আর খিদে পেলে শিশু খাবেই। যদি সুনির্দিষ্ট সময় ছাড়া শিশুকে খাওয়ানোর অভ্যাস করা হয়, তাহলে কিছু কিছু ক্ষতির শিকার হবে ওই শিশু।

শিশুকে খাবারে উৎসাহী করতে যা করবেন

বাচ্চাদের খাওয়ানোর উপায় কি? খাবারের প্রতি শিশুর পূর্ণরুচি ফিরিয়ে আনতে আমরা আছি আপনার পাশে। শিশু না খাওয়ার পেছনে দায়ী যথাযথ কারণ ও সমাধান তুলে ধরলাম। চেষ্টা করুন এগুলো মেনে চলতে। দেখবেন, আপনার প্যারেন্টিং হবে সেরা প্যারেন্টিং।

১। পূর্ণভাবে খিদে

অনেক শিশুই পরিপূর্ণভাবে খিধা না লাগলে খেতে চায় না। অথবা খেতে বসলেও পরিপূর্ণভাবে খিদা না লাগার কারণে প্লেটের ভাত শেষ করে না।

২। খাওয়া শেষ না হতেই খাওয়া

আমরা সাধারণত শিশুদের বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। হ্যা, এটা খুব ভালো। এতে শিশুর রুচি পরিবর্তন হয় এবং বহুমুখী খাদ্যের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু মাঝখানে একটা ছোট্ট ভুল আমরা করে বসি। দেখা যায়, বিস্কিট খাওয়া শেষ হতে না হতেই আম, কলা, কাঁঠাল কিংবা চকলেট এর খাবারগুলো তাকে খেতে দেই। এতে শিশুর ভাতের প্রতি রুচি নষ্ট হয়ে যায় এবং খাবারের প্রতিও অনীহা দেখা দেয়। ফলে শিশুর না খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।

৩। অসুস্থতা

অসুস্থতার কারণেও শিশুদের খাবারে অরুচি দেখা দেয়। ঠাণ্ডা, জ্বর কিংবা পেট খারাপ থাকলে শিশুরা নিজেকে খাবার থেকে কিছু সময়ের জন্য দূরে রাখতে পারে। তবে এটা বেশ কিছু সময় পর ঠিক হয়ে যায়। এছাড়া শিশুর জিহ্বায় ঘায়ের আবির্ভাব ঘটলেও শিশুরা খাবার গ্রহণে অনীহা দেখায়। যদি শিশুর পেটে কিংবা অন্ত্রে কোনো জটিলতা দেখা দেয়, তবে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।

৪। খাবারে এলার্জি

খাবারে এলার্জি – শিশু না খাওয়ার আরেকটি কারণ। খাদ্যে এলার্জির কারণে অনেক শিশুই স্বাভাবিক খাবার খেতে চায় না। ৪ থেকে ৮ শতাংশ শিশু খাবারে এলার্জির কারণে অনেক খাবার যেমনঃ ফল, শাক, ডিম, গরুর মাংস ইত্যাদি খায় না। তাই খেয়াল রাখুন, খাবারে বাচ্চার এলার্জি হচ্ছে কিনা।

৫। খাবারের স্বাদ

শিশুরা খাবারের স্বাদ ঠিকমত গ্রহণ করতে পারে না। যার কারণে, বার বার একই ধরনের খাবার গ্রহণের ফলে শিশুরা কিছুটা বিরক্ত বোধ করে। তাই চেষ্টা করুন শিশুর পছন্দসই খাবার রান্না করতে। প্রতিদিন তাকে জোর করে নির্দিষ্ট কোনো খাবার খাওয়ানো উচিত নয়। এতে খাবারের প্রতি অনীহা আরো বেড়ে যায়। এজন্য একই খাবারকে নতুনভাবে রান্না করুন।

৬। অযথা জোর করবেন না

খাওয়ানোর জন্য শিশুদেরকে অযথা জোর করবেন না। শিশুরা সাধারণত আনন্দের সহিত খেতে পছন্দ করে। কিন্তু যখন তাকে একবার জোর করে খাওয়ানো হয় তখন সে প্রচণ্ড ভয় পায়। আর এতে খাবারের প্রতি তার আগ্রহ কমতে থাকে। এমনকি এক সময় খাবারের প্রতি তার বিতৃষ্ণাও দেখা দিতে পারে।

৭। সময়সূচী অনুযায়ী খেতে দিন

বয়সের পার্থক্য অনুযায়ী শিশুদের ক্ষুধা লাগার কিছুটা ভিন্নতা আছে। নিয়ম বা সময়সূচী অনুযায়ী শিশুদের খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুললে খাবারের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ে। শিশুকে কী খাওয়াচ্ছেন, তার চেয়ে বড় কথা হলো, কখন খাওয়াচ্ছেন। শিশু খাচ্ছে না কিংবা খেতে চাইছে না – এমন অযুহাত দেখিয়ে তাকে বার বার খাবার দিবেন না। যদি শিশু একেবারেই খেতে না চায় তাহলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। মনে রাখবেন, যখন-তখন খাবার দিলে বাচ্চাদের ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যায়। তাই এ কাজটি থেকে বিরত থাকুন এবং বাচ্চাকে রুটিন অনুযায়ী খাবার দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন।

৮। খাবারের বিরতি

বয়সভেদে শিশুদের খাবারের মাঝে কিছুটা বিরতিও প্রয়োজন। কেননা, খিদে না লেগেই বাচ্চাকে খাবার দিলে সে খাবারের প্রতি অনীহা দেখা দিতে পারে।

গবেষণায় এটা দেখা গেছে, ২ থেকে ৩ বছর বয়সী একজন শিশুর প্রতিবেলা খাবারের ফাঁকে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় বিরতি দেওয়া উচিত। আর এই সময়টাতে যদি শিশুকে অন্য কোনো খাবার দেওয়া না হয় তবে তার পরিপূর্ণভাবে ক্ষিধা লাগবে। অর্থাৎ শিশু স্বাচ্ছন্দ্যে খাবার গ্রহণ করবে।

আবার, ৩ থেকে ৪ বছর বয়সী একজন শিশুর প্রতিবেলা খাবারের ফাঁকে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় বিরতি দেওয়া উচিত। প্রতিবেলা খাবারের ফাঁকে এই বিরতির সময়টা শিশু বয়স থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত একটু করে বৃদ্ধি পাবে। এক সময় বড়দের মতো তিন বেলা খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

৯। খাবার সময় কার্টুন বা টিভি দেখা নয়

অনেক সময় শিশুরা খেতে না চাইলে তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমরা বেশ কিছু ভুল পন্থা অবলম্বন করি। আর সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো টিভিতে তাদের পছন্দসই কার্টুন দেখা।

হ্যা, টিভিতে কার্টুন দেখাতে দেখাতে শিশুদের খাওয়ানো হলে এক সময় তারা সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে এবং টিভি না দেখলে খাওয়া মুখেই নিবে না। এছাড়া টিভির প্রতি মনোযোগ থাকার কারণে তাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। এমনিতেই বেশি সময় ধরে টিভি দেখা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। এমনকি টিভি দেখার সময় খাওয়ালে শিশুর বদহজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা, টিভির দিকে মনোযোগ থাকার জন্যে পাকস্থলী থেকে প্রয়োজনীয় পাচক রস নিঃসৃত হয় না।

১০। খাবারে ভিন্নতা আনুন

আপনি, আমি, আমরা কেহই প্রতিদিন একই ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করি না। সবাই একটু ভিন্ন স্বাদের খাবার খেতে পছন্দ করি। শিশুদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। তাই প্রতিদিন তাকে একই রকমের খাবার না দিয়ে খাবারে বৈচিত্র আনুন। যদি শিশু মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে তবে সে যা খেতে চায় সে অনুযায়ী খাবার বানিয়ে দিন। পছন্দের খাবারটি তাকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করে পরিবেশন করুন। তবে তাকে বাইরের খাবারের অপকারিতা সম্পর্কে অবগত করুন।

১১। বাইরের খাবার

বাইরের খাবার যে একেবারেই দেবেন না এমনটা নয়। কেননা, বড়দের সঙ্গে বিয়ে কিংবা বার্থডে পার্টিতে গেলে, পরিবারের সাথে ঘুরতে গেলে নিশ্চয়ই তাকে বাইরের খাবার খেতে হবে। তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে রুটিন করে তার জন্য চকলেট, কেক, পটেটো কিংবা মুখরোচক খাবারগুলো আনবেন না বা তাকে বাইরে খেতে নিয়ে যাবেন না। মুখরোচক এই খাবারগুলো গ্যাস্ট্রিকের পাশাপাশি শিশুদের নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করে।

১২। যখন তখন খাবার

রুটিন অনুযায়ী শিশুদের খাবার খাওয়াই ভালো। কিন্তু শিশুরা যখন তখন খাবার খেলে যথাসময়ে আর তাদের খিদে লাগবে না। আর সে খেতেও পারবে না।

দেখা যায়, অনেক শিশু বিদ্যালয় থেকে ফিরেই বিস্কিট-চানাচুর কিংবা ফলমূলের রস খেয়ে থাকে। আর তার এক ঘণ্টা পরেই হয়তো দুপুরের খাবার গ্রহণের সময় হয়ে যায়। এ সময় সে ঠিকমত খেতে চাইবে না, কেননা ইতোমধ্যেই তার ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গেছে।

আবার অনেক শিশুকে দেখা যায় সারাদিনে যখন তখন বিস্কুট, কলা, রুটি, লজেন্স কিংবা আইসক্রিম এর মত খাবারগুলো পেট ভর্তি করে খেতে। যার ফলে মূল খাবারের সময় তেমন কিছুই খেতে চায় না।

১৩। অতিরিক্ত দুধ খাওয়ানো

ছোট বাচ্চাদের পেটও ছোট থাকে। এ কথাটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। আমরা সবাই জানি, শিশুদের ৬ মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধই তাদের জন্য উত্তম এবং পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু ছয় মাস হওয়ার পরেও শক্ত খাবার না দিয়ে শিশুকে আগের মতই বুকের দুধ খাওয়ালে অন্য খাবারের প্রতি তার অনীহা হতে পারে। কেননা, ছোট পেটে দুধ খাওয়ার পরে অন্য খাবার গ্রহণের পর্যাপ্ত জায়গা থাকে না। তাই ৬ মাস পর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো কমিয়ে দিয়ে শক্ত খাবার খাওয়ার জন্য জায়গা করে দিতে হবে।

১৪। খাবারের ধরণ বা গন্ধে

খাবারে গন্ধ বা খাবার পরিবেশনের ধরনে অনেক শিশুরই সমস্যা থাকে। যেমনঃ অনেক শিশু আছে যারা অতিরিক্ত নরম খাবার পছন্দ করে না। এছাড়া গন্ধের জন্য তারা শাকসবজি ও ফলমূল খেতেও ‘না’ সূচক শব্দ ব্যবহার করে। একে texture sensitivity বলে।

১৫। মাছ, মাংস ও ডিম খায় না

অনেক শিশুই আছে যারা মাছ, মাংস ও ডিম খেতে পছন্দ করে না। শিশুরা এসব গ্রহণ না করলে একেবারেই টেনশন নিবেন না। শুধু আপনাকে খাবার পরিবেশন এর ধরনটা পাল্টাতে হবে। মাছ খেতে না চাইলে তাকে ফিশকাটলেট বানিয়ে দিন। চিংড়ির সাথে নুডুলস রান্না করুন। মাংস খেতে না চাইলে তাকে চিকেন ফ্রাই বা কাবাব বানিয়ে দিন। ডিম খেতে না চাইলে সুজির সাথে বা খিচুড়ির সাথে ডিম রান্না করুন। ডিমের স্যুপ বা চপও দিতে পারেন।

খাবার গ্রহণে শিশুর আগ্রহ বাড়ানোর উপায়

শাকসবজি, রুটি, মুরগি, ডিম, মাছ, মাংস ও ফলমূল সব কিছুই শিশুকে খাওয়ার অভ্যাস করাতে হবে। আর তাই জানা প্রয়োজন নানা ধরনের রন্ধন পদ্ধতি। একই রকমের খাবার বার বার খেতে না দিয়ে ঐ খাবারকে ভিন্নভাবে প্রস্তুত করুন এবং বাচ্চার সামনে পরিবেশন করুন। দেখবেন, বাচ্চা ঠিকই তা গ্রহণ করবে।

বাচ্চা যখন প্রথম খাওয়া শুরু করে তখন থেকেই বিচি ছাড়া পটল, আলু, ঝিঙা, গাজর, জালি, পেঁপে ইত্যাদির মত সবজিগুলো দেওয়া যেতে পারে। এরপর এক বছর বয়সে তাকে শাক খেতে দিন। তবে এটা দেখুন হজম হয় কিনা। শাক ঠিকমত হজম হলে তাকে অন্যান্য শাক খেতে দিন। ফলের মধ্যে প্রথমে চটকানো কলা, লেবু বা মাল্টার রস, আপেল, আনারের রস খেতে দিন। ধীরে ধীরে দাঁতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও শক্ত দাঁতের ওপর নির্ভর করে অন্যান্য ফলমূল দেওয়া যেতে পারে।

সেরিলাক (পটের দুধ) শিশুদের খিদে নষ্ট করে দেয়। এর বদলে শিশুকে সুজি, রুটি, ওটস, সাগু ইত্যাদি খাওয়ান। শিশুকে প্রথম থেকেই মাছ-শাকসবজি ইত্যাদি খাবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। তাহলে পরবর্তীতে এসব খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ করে না।

অনেক শিশু ডিম খেতে চায় না। এক্ষেত্রে তাকে খাওয়ানো যেতে পারে ডিমের স্যুপ বা পুডিং এবং রান্না করা ডিম। এছাড়াও পুডিং, ছানা, দই, মিষ্টি, সেমাই পারেন দুধের বদলে। শিশুর বর্ধনে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য মাছ, মাংস, দুধ, ডিম বেশি থাকা দরকার।

শিশুর খাদ্যতালিকায় শাকসবজি কম থাকলেও প্রবলেম নেই। তবে দিনে অল্প হলেও রাখতে হবে। মাঝে মাঝে শাক ভাজি বা খিচুড়ির ভিতরে দিয়ে রান্না করে খাওয়ান।

সরাসরি মাংস খেতে না চাইলে চিকেন ফ্রাই বা কাবাব করে খাওয়ান। নুডলসের সাথে ডিম, মাংস, চিংড়ি, সবজি ইত্যাদি দিয়ে আরো মজাদার করে তুলুন। সরাসরি মাছ খেতে না চাইলে তাদের মাছের বড়া করে দিন।

টেস্টিং সল্ট শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই শিশুর খাবারে টেস্টিং সল্ট দেওয়া একেবারেই নিষেধ। শিশু যেন আলগা লবণ না খায়। এতে শিশুর স্বাদ নষ্ট হয়। শিশুর ঠাণ্ডা লাগলে চা দেওয়া যাবে না। তবে গরম স্যুপ দেওয়া যেতে পারে।

প্রশ্ন – উত্তর পর্ব


শিশুর খাবারে অরুচি কেন হয়?

বাচ্চাদের খাবারে অরুচি খুব কমন একটা বিষয়। কোন অসুখ, মন খারাপ বা কৃমি জনিত সমস্যার জন্য বাচ্চার খাবারে অরুচি হতে পারে। এটা নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। কারণ এটা খুব সাময়িক। যতটা পারেন বাচ্চাকে কম চাপ দিন, পড়াশোনা নিয়ে বেশি চাপ দিবেন না, ভয় দেখাবেন না। ভয় ও মানসিক চাপ অরুচির প্রধান কারণ। তাই বাচ্চার সাথে বন্ধুর সাথে মিশুন, তাদের উৎসাহ দিন, ভালোবাসা দিন, খেলতে দিন। বাচ্চারা খেলা করলে এমনিতেই খাবারে অরুচি চলে যাবে। তবে খাবার একটু মজাদার এবং ভিন্ন রেসিপিতে পরিবেশন করুন। তার পছন্দের খাবার দিন।

আমার মতে নিজে থেকে স্বাভাবিক ভাবে ঠিক হয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাই করা উচিত। একটুতেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর অভ্যাস বাদ দিন। বাচ্চার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করুন, বাচ্চাকে দূর্বল বানাবেন না। সামান্যতেই ভয় না পেয়ে একটু সময় নিয়ে দেখুন ঠিক হয় কিনা, কারণ শরীরের বেশির ভাগ সমস্যা শরীর ওষুধ ছাড়াই এমনিতে ঠিক করে। তাই খুব বড় কোন সমস্যা না হলে ডাকারের কাছে যাবেন না, এমনিতেই শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড়দের থেকে বেশি।


শিশুর খাবারে অনিহা কেন হয়?

আমার একটি বাস্তবিক অভিজ্ঞতা আপনাদের বলি, হয়তো আপনিও খেয়াল করে দেখেছেন বিষয়টা- অসহায় গরীব বাচ্চারা যা দেন তাই খায়, খাব না কথাটা তারা বলে না! কিন্তু যে বাচ্চার পিছনে বাবা-মা লেগে থাকে, বাবা এটা খাও, ওটা খাও। অথচ শিশু খেতে চায় না। এর কারণ কি ভেবে দেখেছেন? উত্তর- সহজলভ্যতা। মানুষের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল যেটা সে সহজে পায় সেটার মূল্য দেয় না।

বাচ্চাদের সব সময় খাবারের কথা বলবেন না, কথায় আছে না, খিদে লাগলে বাঘে ধান খায়। এজন্য তার খিদে লাগার সময় দিন। এজন্য তাকে একটু খেলার সময় দিন, লাফালাফি, দৌড়াদৌড়ি করলে খিদের জ্বালায় আপনাকে সময় দিবে না। অনেকে বাচ্চাদের দোকানের খাবার যেমন- চিপ্স, চকলেট ইত্যাদি খিদে নষ্ট করা খাবার বেশি দেয়, ফলে বাচ্চার ক্ষুধামন্দা হয়।

শিশুদের এক খাবার সব সময় দিবেন না, খাবারে একটু বৈচিত্র আনুন। একই খাবার ভিন্ন পদ্ধতিতে রান্না করুন। যে খাবার সে খেতে চায় না তা একটু ভিন্ন রেসিপিতে পরিবেশন করুন। বাচ্চারা মজাদার খাবার পছন্দ করে বেশি, এজন্য খাবারে ভিন্ন স্বাদ আনুন।

খাবারের প্রয়োজনীয়তা বা মূল্য না বুঝলে সেটার আনন্দ থাকে না। অসহায় গরীব বাচ্চাদের শুধু ভাত দেন দেখবেন খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে। কিন্তু যত বাহানা আপনার বাচ্চা করে। এর কারণ আপনি নিজেই। আপনি তাকে বেশি মূল্য দিয়ে ফেলেছেন। আমার মা ছোটবেলায় আমাকে সব খাবার খাওয়া শিখিয়েছেন।

আমি যদি কোন খাবার খেতে পছন্দ না করি সেটা টানা তিন দিন চলত, অর্থাৎ আমি নিরামিষ খেতে চাইতাম না, তাই আমার মা অন্য তরকারি বাদে শুধু নিরামিষ রান্না করে রাখতেন। তখন আর কোন উপায় না পেয়ে খিদের জ্বালায় নিরামিষ দিয়ে ভাত খেতাম। এভাবে আমি সব খাবার খাওয়া ছোটবেলা থেকে শিখেছি। এখন ম্যাচে বা হোস্টেলে থাকলে আমার কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু আমার অনেক বন্ধু আছে যারা আমিষ না হলে খেতেই পারে না। ছোটবেলায় যদি তাদের বাবা-মা সব খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস করাতেন, তাদের বাহানা বা জেদের গুরুত্ব না দিতেন তাহলে তারা আজ কষ্ট করে না খেয়ে থাকতে হয় না।

তাই আমার ব্যক্তিগত সাজেশন হবে আপনি বাচ্চাদের সব খাওয়ার অভ্যাস করান। খেতে না চাইলে চুপ থাকেন, খাবার নিয়ে তাকে বলতে যাবেন না খাও। তার জেদ বা বাহানার কথা শুনবেন না। দেখবেন সে নিজে থেকে খাবার খেতে শুরু করবে। ছোট থেকেই বাচ্চাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ করে দিন। মন খারাপ করে, বা জেদে আপনার বাচ্চা না খেয়ে থাকলে শুকায় যাবে, ক্ষতি হবে এমনটা ভাববেন না, কারণ বাচ্চারা বড়দের মত খিদে সহ্য করতে পারে না। তাই যখন খিদে লাগবে তখন দেখবেন ঠিকি খেতে বসেছে।


খাবারে শিশুর রুচি বাড়ানোর উপায় কি?

– খাবার আধা ঘন্টা আগে জল পান করান।
– শিশুদের পছন্দমতো খাবার বেছে নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। এতে শিশুর খাবারের চাহিদা বাড়বে।
– জিঙ্কের অভাব ক্ষুধা ক্ষতির জন্য দায়ী, তাই জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়ান। কাজু বাদাম, গম, কুমড়া ইত্যাদি জিংক সমৃদ্ধ।
– আপনি যদি কোনো খাবার অপছন্দ করেন তবে তা শিশুর সামনে বলবেন না।
– শিশুদের জোর করে খাওয়াবেন না।
– খেলাধুলা এবং ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করুন।
– শিশুদের একই খাবার প্রতিদিন খাওয়াবেন না। সপ্তাহে সাতদিন শিশুর খাবারের রেসিপি তৈরি করুন।
– মাকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে। মাকে দেখে শিশু ওই খাবার খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করবে।
– স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি উৎসাহিত করতে শিশুদের পার্কে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারেন।
– স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার জন্য পুরস্কার দিন ও প্রশংসা করুন।
– শিশুর মধ্যে একসঙ্গে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
– খাবার খাওয়ানোর সময় গল্প, কবিতা ও ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলুন।

আশা করি, আপনার শিশুর খাওয়ার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, বাবা-মা হিসেবে একটু কৌশলী ও ধর্যশীল হলেই বেশিরভাগ সমস্যা সহজে সমাধান হয়ে যায়। তাই আপনার সন্তানকে সুশিক্ষা দিন, ছোট বেলা থেকে ভালো অভ্যাস গড়ে তুলুন, উৎসাহের সাথে নিজের ইচ্ছায় খাবার গ্রহণে অভ্যাস গড়ে তুলুন। সঠিক পুষ্টি এবং সুসাস্থ্য নিশ্চিত করুন।

আরো পড়ুন – নবজাতক শিশুর যত্ন ও পরিচর্যার নিয়ম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *