শিশুর মিথ্যা বলা দূর করার উপায় – How To Deal With A Child That Lies: শিশু মন ভীত একটুতে মিথ্যা বলার আশ্রয় নেয়। তবে কেউ এমনি এমনি মিথ্যে বলে না, কোন না কোন কারণ থাকে। তবে শিশুরা বাবা মায়ের সামনে বেশিরভাগ সময় মিথ্যে বলে শাসন বা মাইরের ভয়ে। যেটা থেকে সে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং মিথ্যাবাদী হয়।
এটা হয়তো আমরা সবাই জানি, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ।’ কিন্তু শিশুরা তো আর সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বুঝে না। তাই তারা প্রায়ই মিথ্যার প্রশ্রয় নেয়। এটি শিশুদের একটি সাধারণ সমস্যা।
কেন শিশুরা মিথ্যা বলে?
আসুন জেনে নেওয়া যাক, শিশুরা কেন মিথ্যা কথা বলে-
১। সমবয়সীদের সঙ্গে ঝগড়া ফ্যাসাদ করে শিশুরা মিথ্যা কথা বলে।
২। বন্ধুবান্ধবদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বা তাদের বাহাদুরি দেখাতেও শিশুরা মিথ্যা কথা বলে।
৩। নিজের ভুলত্রুটি আড়াল করতে শিশুরা মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
৪। বকা বা শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য শিশুরা মিথ্যা বলে থাকে।
৫। অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যও বাচ্চারা মিথ্যা কথা বলে।
৬। মনের অতৃপ্ত ইচ্ছা পূরণের জন্য বাচ্চারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
৭। শিশুরা সাধারণত অনুকরণ প্রিয়। তাই বড়দের মিথ্যা বলা দেখে তারাও মিথ্যা বলতে শেখে।
৮। কোনো বিষয়কে একটু বাড়িয়ে বা অতিরঞ্জিত করতে।
মিথ্যা কথা বললে কি হয়?
১। এক মিথ্যাকে ঢাকতে হাজার মিথ্যার জন্ম হয়।
২। মিথ্যাচারীকে সমাজের কেউ ভালোবাসে না ও ভালোচোখে দেখে না।
৩। মিথ্যা কথা বলার কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
৪। মিথ্যা, ব্যক্তি চরিত্রের একটি সবচেয়ে খারাপ গুণ।
৫। মিথ্যা মানুষকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়।
৬। সকল পাপের মূল হচ্ছে মিথ্যা কথা।
৭। মিথ্যাবাদী সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে।
৮। মিথ্যাবাদী তার মিথ্যা প্রকাশ হয়ে পড়ার আশংকায় সবসময় মানসিকভাবে অস্বস্তিতে ভোগে।
৯। যারা মিথ্যা কথা বলে তারা অন্যদেরও একই রকম মিথ্যাবাদী মনে করে।
১০। মিথ্যাবাদীদের সম্মান না থাকায় সে নির্লজ্জের মতো যে কোন ধরনের কাজে লিপ্ত হয়।
শিশুর মিথ্যা বলা যেভাবে দূর করবেন
প্রথমে শিশুর মিথ্যা বলার কারণটি খুঁজে বের করুন। তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন এবং সে কী চাচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করুন। শিশুকে যুক্তি দিয়ে বোঝান মিথ্যা কথা বলা কতটা ক্ষতিকর। তাকে সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য শেখান এবং কেন মিথ্যা কথা বলা উচিত নয় তা বোঝানোর চেষ্টা করুন।
১। শাস্তি দিবেন না
‘শাস্তি’ সঠিক সমাধান নয়। সাধারণত দেখা যায়, সন্তান মিথ্যা বললে বাবা মায়েরা তাকে শাস্তি দেয়। আসলে এক্ষেত্রে শাস্তি তেমন কোনো কাজে আসে না। বাচ্চা প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরে ঐ কাজটা ঠিকই পুনরায় করে।
উদাহরণস্বরূপ, আপনার বাবুটা দৌড়াতে গিয়ে টেবিলের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। যার ফলে কাঁচের একটা গ্লাস পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। শব্দ শুনতে পেয়ে আপনি পাশের ঘর থেকে দৌড়ে ছুটে আসলেন ঘটনাস্থলে। ভয়ে কাতর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাবুটাকে রাগী মুডে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে ভাংলো এটা?’ উত্তরে বাচ্চা বলল, বিড়ালটা দৌড়াতে গিয়ে ফেলে দিছে। আপনার শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য সে সত্যিটাকে আড়াল করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আপনি তার হাবভাব দেখেই বুঝতে পারছেন, গ্লাসটা ভাঙার জন্য কে দায়ী? ব্যস, অমনি তাকে শুরু করে দিলেন মারধর। বললেন, ‘আমি জানি এটা তুমি ভাংছো। আরো এভাবে দৌড়ালে ঠ্যাং খোড়া করে দিব’, মনে রাখিও। হয়তোবা, আপনি ভাবছেন এটাই তার জন্য সঠিক সমাধান। কিন্তু মোটেই না।
কিভাবে দূর করবেন?
প্রথমে তাকে জানান, আপনি তার মিথ্যা বলার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন।
- তাকে মারধর কিংবা বকাঝকা একেবারেই করবেন না।
- গ্লাসের ভাঙা টুকরোয় সে আঘাত পেতে পারে। তাই তাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিন।
- তাকে অভয় দিন এবং বলুন ‘বাবু তোমার কোথাও লাগেনি তো।
- অতঃপর তাকে সাবধান করুন, সংশোধন করে দিন।
- সেই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিন, আপনার কথা না শুনলে কী কী শাস্তি সে পেতে পারে। এরপর তাকে বিষয়টি খুলে বলার জন্য সুযোগ দিন, স্বীকার করার সুযোগ দিন। এভাবে জিজ্ঞেস করলে বাচ্চা কখনোই আপনাকে মিথ্যে বলবে না।
২। সত্য বলার জন্য আদর করুন
‘ভয়’ খুব মারাত্মক একটি শব্দ। আর শিশুদের ক্ষেত্রে এটা আরো প্রকট হয়। শিশুরা যদি আপনাকে ভয় পায় তাহলে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার থেকে বাঁচতে তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
উদাহরণস্বরূপ, অনেকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও আপনার আদরের বাবুটা গাছে উঠতে গিয়ে পড়ে গেছে। সে বেশ আঘাতপ্রাপ্তও হয়েছে। কিন্তু সে আপনার কাছে এসে সব সত্যিটা বলে দেয়। সে জানায়, ‘বাবা তোমার নিষেধ সত্ত্বেও আমি আবারো গাছে উঠতে গেছিলাম। কিন্তু পড়ে গিয়ে বেশ ব্যথা পেয়েছি। আর আমি গাছে উঠবো না।’
আপনি তার সত্যি বলাটাকে গ্রহণ করুন। তাকে বকাঝকা না করে বরং আদর করুন।
আরো যা যা করবেন –
- ‘আমি আর গাছে উঠবো না।’ একথাটি বলা থেকে তাকে বিরত রাখুন। কেননা, এতে সে আর কখনোই গাছে উঠার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ নাও করতে পারে।
- তাকে এটা বলুন, ‘তুমি এখনো অনেক ছোট। এখন যদি তুমি একা একাই গাছে উঠতে যাও তাহলে পড়ে যেতে পার।’
- বরং আমাকে সাথে নিয়ে গাছে উঠিয়ো। আমি তোমাকে ঐ সময় গাছে উঠতে সাহায্য করবো এবং গাছে উঠার কৌশলগুলোও শিখিয়ে দিব।
- এতে তার ভয় কমে যাবে এবং আপনাকে একজন প্রকৃত বন্ধু ভাববে।
এছাড়াও আপনি তার সাথে মিথ্যা কথা বলার ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
৩। সমস্যা একত্রে সমাধান করুন
অনেকক্ষেত্রে শিশুরা সমস্যায় পড়লে মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
উদাহরণস্বরূপ, কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে তারা ঈদে একটি ছোট্ট বিজনেস করার সিদ্ধান্ত নিল। দুঃখের বিষয়, আপনার বাচ্চার কাছে কোনো টাকা নেই। সেও এই বিজনেসটা করতে চায়। কিন্তু আপনাকে বলতে ভয় পাচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিল আপনাকে বলবে, কোনো এক বন্ধুর কাছে সে ১০০ টাকা ধার নিয়েছে। সেটা দিতে হবে। হ্যা, এরকম কোনো সমস্যায় পড়লেও বাচ্চারা মিথ্যা বলে।
কিভাবে দূর করবেন?
- বাচ্চা যদি বিষয়টি আপনার কাছে তুলে ধরে তাহলে তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। আর মিথ্যা বললে কৌশলে জানার চেষ্টা করুন।
- তাকে বলুন, আপনি তাকে সাহায্য করবেন।
- এতে শিশুর নিজের প্রতি যেমন বিশ্বাস বাড়বে তেমনি আপনার প্রতিও তার বিশ্বাস বাড়বে।
- বরং তারা যেন বিজনেসটাতে সফল হয় সেজন্য তাদের আরো উৎসাহিত করুন এবং ভালো পরামর্শ দিন।
মনে রাখবেন, ছোট ছোট বিজনেস এর মাধ্যমেই কিন্তু বড় বিজনেসের স্বপ্ন দেখা যায়। আজকে যারা সফল তারাও প্রথমে এভাবেই শুরু করেছিল। এভাবে তাদের সৎ সাহস দিয়ে মিথ্যা বলার প্রবণতাটাকে দমিয়ে দিতে পারেন।
৪। তাকে পছন্দ করতে দিন
আপনি কালো শার্ট পরেন না। কিন্তু আমি যদি জোর করে বলি, ‘কালো শার্টই পরতে হবে।’ তাহলে আপনাকে কেমন লাগবে? হ্যা, নিজের পছন্দের বিরুদ্ধে যখনই আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দেই তা আমাদের সহ্যের বাহিরে চলে যায়।
শিশুদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা কিছুটা এরকম। অনেক বাবা-মা ই আছেন যারা শিশুদের হাতের লেখা, ব্যাগ গুছানো, ব্রাশ করা, চুল আঁচড়ানো, জুতা মোজা পরার মত কাজগুলো সব ঠিক করে দেন। অভিভাবকরা তাদের নিজস্ব মতামত বারবার সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেন। এমনকি, বাচ্চা টিভিতে কোন প্রোগ্রাম দেখবে, কোন কালারের পোশাক পরবে, কি খাবার খাবে এসব কিছুই তারা জোর করে চাপিয়ে দেন। ফলে শিশুর মধ্যে তিক্ততা, বিরক্তি, অজুহাত কিংবা মিথ্যা বলার মত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কি করবেন?
- শিশুর ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে না দিয়ে তাকে পছন্দ করার সুযোগ দিন।
- এতে সে তার নিজস্ব মত প্রকাশেও সুযোগ পাবে।
- নিজের কাজগুলো তাকে নিজে করতে শেখান। নতুবা এ ঘানি আপনাকে বহুদিন পর্যন্ত টানতে হতে পারে।
এতে হয়তো লুকিয়ে কিছু করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করবে না।
৫। বাবা-মা’র মিথ্যে বলার অভ্যাস
বাচ্চা কোনো শিক্ষা নিয়ে জন্মে না। তারা পরিবেশ এবং আমাদের নকল করে শিখে। আমাদের অজান্তেই তারা আমাদের নকল করে। বড়রা শিশুর সামনে হয়তো এক রকম বলছেন, কাজের বেলায় অন্য রকম করছেন। শিশুর মন ভোলাতেও বড়রা অনেক সময় মিথ্যার আশ্রয় নেন। তাই বাচ্চা বলে তাদের অবহেলা করবেন না। সুতরাং তাদের সামনে মিথ্যা একেবারেই নয়।
উদাহরণস্বরূপ- আপনার স্ত্রী বলল, বাবুর জন্য একটা খেলার ব্যাট আনিও। আপনি বললেন, ঠিক আছে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ব্যাট আনছেন কিনা জানতে চাইলে আপনি বললেন, আজকে টাকা ছিল না। কালকে নিয়ে আসব। আবার আগামীকাল সন্ধ্যায়ও বাসায় ফিরে বললেন, আজ মনে ছিল না। কাল নিয়ে আসব। এভাবে মিথ্যা বলে বলে আপনি কয়েকদিন কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার এ মিথ্যা বলাটা তার মধ্যে একটি নেগেটিভ সাইট তৈরি করবে। আপনার দেখাদেখি সেও মিথ্যা বলতে শুরু করবে।
কিভাবে দূর করবেন?
- বাচ্চাকে শুধরানোর আগে নিজে শুধরে নিন। মিথ্যা বলার অভ্যাস ত্যাগ করুন।
- ভুলবশত, ব্যাট নিয়ে নাই আসতে পারেন। তবে সত্যটা তুলে ধরুন।
- বাচ্চার সামনে বা বাচ্চার অগোচরেও মিথ্যা বলার অভ্যাসটা ছেড়ে দিন। কেননা, দেয়ালেরও কান আছে। একথাতো সবাই জানে।
৬। নিজেদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করতে
মনে রাখবেন, বাচ্চারা কিন্তু ভাবুক। বন্ধুদের সামনে ভাব নিতে বা তাদের থেকে স্পেশাল বা মর্যাদাবান বোঝাতে কিংবা তাদের চমকে দিতে শিশুরা মিথ্যা কথা বলে। তবে সেই মিথ্যাটাকে অন্য বন্ধুরা অজান্তেই যদি বিশ্বাস করে তবে ঐ শিশুর মিথ্যা বলার প্রাবল্য আরো বেড়ে যায়। কেননা, তার মাথায় এটাই কাজ করে যে মিথ্যা বলে প্রচুর সম্মান পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপ- ৭-৮ বছরের কয়েকজন শিশু গল্প করছে। ১ম জন বলল, আমি দুইটার বেশি মিষ্টি খেতে পারি না। ২য় জন বলল, আমি ৪ টা পর্যন্ত পারি। ৩য় জন বলল, আমি ৩ টা পর্যন্ত পারি। কিন্তু আপনার বাচ্চা যে কিনা মিষ্টিই পছন্দ করে না। সে তাদের মাঝে ভাব নেওয়ার জন্য বলল, ধুর আমি ১০ টা খেলেও কিছু হয় না।
হ্যা, ঠিক এমন কিছু মহুর্তে বাচ্চারা বন্ধুদের থেকে নিজেকে স্মার্ট বানাতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
কিভাবে দূর করবেন?
- সামান্য মিথ্যা বললে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে পরিমান বেড়ে গেলে অবশ্যই জানার চেষ্টা করুন, কেন তারা মিথ্যা বলছে।
- যদি এরকম হয়, তবে তার সাথে মিথ্যা বলার কুফলগুলো নিয়ে আলোচনা করুন।
- প্রকৃষ্ট কোনো উদাহরণ দিয়ে তাকে বোঝাতে পারেন।
- তাদের ‘দূর-ছাই’ করে তাড়িয়ে দেবেন না।
৭। নজর পেতে
হ্যা, অনেক শিশুই আছে যারা তাদের দিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হঠাৎ হঠাৎ মিথ্যা বলে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বলে এইমাত্র জানালা দিয়ে বাঘ দেখলাম। তাহলে বুঝতে হবে, ওই বাচ্চা আপনার মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। আর তাতে কাজ হলে শিশু বারবার মিথ্যা কথা বলবে।
কিভাবে দূর করবেন?
- বাচ্চাদের কথা মন দিয়ে শুনলে এই সমস্যা কেটে যাবে।
- সে কি বোঝাতে চাচ্ছে সেদিকে মনযোগী হোন।
৮। বাড়িতে গায়ে হাত তোলার অভ্যাস থাকলে
এখনও বাড়ির বাচ্চাদের গায়ে হাত তুলে এক প্রকার সুখ পান বড়রা। কারণে অকারণে এই শাসন নেমে আসে। তাই এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় যে, শিশুরা মারের হাত থেকে বাঁচতে তারা মিথ্যা কথা বলবে।
উদাহরণস্বরূপ, আপনার পকেট থেকে বাচ্চা প্রতিদিন ১০-২০ টাকা চুরি করে স্কুলে খাওয়ার জন্য। টাকাটা খুব নগণ্য হওয়ায় আপনি সেটা টের পান না। কিন্তু হঠাৎ একদিন আপনি আড়াল থেকে স্ব-চোখে দেখতে পেলেন বিষয়টা। পরক্ষণে বাচ্চাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আমার পকেট থেকে টাকা চুরি কর।’ এমন পরিস্থিতিতে মারের হাত থেকে বাঁচতে বাচ্চা মিথ্যা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ সে জানে, পরিবারে আপনি কারণে অকারণে বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলেন।
কিভাবে দূর করবেন?
- তার প্রয়োজনগুলো আসার আগেই মিটিয়ে নিন।
- বাচ্চাদের গায়ে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- মিথ্যা বলার কুফলগুলো নিয়ে তার সাথে আলোচনা করুন।
- তার কোনো প্রয়োজন থাকলে সে যেন আপনাকে জানায়। এজন্য তাকে অভয় দিন ও সৎ সাহস যোগান।
৯। ভয়ের কারণে
শিশুরা অনেক সময় ভয় পেয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। সত্য গোপন করে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি সবসময় রাগি মুডে থাকেন। ঘরের জিনিসপাতি এলোমেলো থাকাটা আপনার একদম পছন্দ নয়। কিন্তু বাচ্চারা তো ঘর এলোমেলো করবেই। এখন দেখা গেল, আপনি তাকে এর জন্য প্রতিনিয়ত শাস্তি দেন। তাহলে পরবর্তী ঘটনাগুলোর জন্য আপনার ভয়ে সে মিথ্যার প্রশ্রয় নিবে।
কিভাবে দূর করবেন?
- শিশু কেন মিথ্যে বলছে সেটা আপনাকে অনুধাবন করতে হবে।
- ঘটনাটা যত খারাপই হোক না কেন, সত্যি বললে আপনি তাকে শাসন করবেন এই আশ্বাস দিন।
১০। সাবধান করার পরেও মিথ্যা বললে শাস্তি দিন
সাবধান করার পরেও শিশু আবার মিথ্যে বললে, তাকে শাস্তি দিন। সেটা শারীরিক শাস্তি কিংবা অতিরিক্ত বকাঝকা করে নয়।
কিভাবে করবেন?
- তার খুব পছন্দের কোনও জিনিস (খেলনা, বা রং পেন্সিলের সেট) নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন।
- ধর্মের জ্ঞান দিয়ে তাকে মিথ্যা বলা থেকে বিরত রাখতে পারেন।
১১। রুপকথার গল্প শোনান
রূপকথা, উপকথার মত গল্পগুলোতে অনেক ধরনের শিক্ষামূলক বিষয় তুলে ধরা হয়। তাই শিশুদের এরকম গল্পগুলো শোনাতে হবে। যাতে ওরা সেখান থেকে ভালো কিছু শিখতে পারে। ভালো কাজ এবং মন্দ কাজ সম্পর্কে ওরা যেন সহজে বুঝতে পারে। মিথ্যা যে ভালো কিছু বয়ে আনে না, সেটা তাদেরকে উপলদ্ধি করান। তাদেরকে দেখান, মিথ্যা মানুষের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে। একটা বয়স পর ওদেরকে বাস্তবতা আর কল্পকাহিনীর মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে দিন।
১২। কল্পনাজনিত মিথ্যার অভ্যাস
অনেক শিশুই আছে যারা কল্পনা করতে ভালোবাসে। কল্পনার জগতে তারা নিজের পছন্দমত সবকিছু তৈরি করে নেয়। কিন্তু কল্পনাজনিত মিথ্যার এই অভ্যাস বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যায়। তবু খুব ছোটবেলা থেকেই শিশুকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সত্য বলার শিক্ষা দিতে হবে। কল্পনা আর মিথ্যার মধ্যে তফাতটা ধরিয়ে দিন। কল্পনাজগত ও বাস্তবতা এক নয়, এটা গল্পচ্ছলে শেখাতে হবে। ঈশপের গল্প বা বিভিন্ন নৈতিক গল্প শুনিয়ে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝানোর চেষ্টা করুন। সত্য বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করুন। সত্য বলার জন্য শিশুকে পুরস্কৃত করুন।
মিথ্যা বলার পর যদি সে সত্যিটা স্বীকার করে নেয়, তাহলে তাকে যতটা পুরস্কার দেবেন বলে জানিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি কিছুদিন। তাতে তার বিশ্বাস বাড়বে। যদি দেখেন কোনও ভাবেই বাচ্চার মিথ্যা বলার অভ্যাস বন্ধ করা যাচ্ছে না, তাহলে মনোবিদের পরামর্শ নিন।
প্রশ্ন উত্তর পর্ব
শিশু মিথ্যাবাদী হয় কেন?
শুরুতেই বলেছি কেউ এমনি এমনি মিথ্যা কথা বলে না! সত্য কথার আনন্দ অনেক তবু কেন বাচ্চারা মিথ্যে বলে ভয়ে থাকে? এর কারণটা হচ্ছে নিজেকে রক্ষা করা। প্রতিটি শিশু তার বাবা মাকে ভয় পায় কারণ বাবা মা কিছু হলেই সন্তানকে বকাঝকা করে, শাস্তি দেয় যেটা শিশুরা নিতে পারে না। তাই এগুলো থেকে বাঁচতে সে মিথ্যের আশ্রয় নেয়। আবার শিশুরা পিতামাতাকে অনুকরণ করে, এখন আপনাকে যদি দেখে মিথ্যে বলছেন তাহলে সেও সেটা করতে চাইবে আবার অনেকে বাচ্চাকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর সঠিক দিতে লজ্জা পায় এবং মিথ্যে কিছু একটা বলে বাচ্চার মুখ বন্ধ রাখে কিন্তু সে যখন জানবে যে এটা মিথ্যে ছিল তখন সেও চাইবে মিথ্যা বলার। ঐযে আগেই বলেছি বাচ্চারা অনুকরণপ্রিয়।
সন্তানকে সত্যবাদী করার উপায় কি?
আপনি যদি আপনার সন্তানকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়তে চান তাহলে সত্যবাদিতা সবার আগে শেখাতে হবে। যত বাঁধা আর বিপদ আসুক না কেন সে যেন সত্য বলে এটা তাকে শেখাতে হবে। এজন্য সে যখন কোন ভুল বা অন্যায় করে ফেলবে তখন কোন ভয় বা শাস্তি না দিয়ে তাকে বোঝাতে হবে সুন্দর ভাবে। যখন সে আপনার কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাবে তখন সে সত্য বলার অনুপ্রেরণা পাবে। তাই বাচ্চাকে ধর্য নিয়ে বোঝান আর আপনি নিজেও একজন সত্যবাদী বাবা-মা হিসেবে তার কাছে পরিচিত হোন।
শিশু মিথ্যা কথা বললে কি করব?
শিশু যখন মিথ্যা বলে তখন তাকে ডিরেক্ট বলবেন না যে তুমি মিথ্যা বলছ! বরং তাকে বলুন বাবা তুমি যেটা করছ তা এই ক্ষতিটা করেছে আর তোমার কাছ থেকে সত্যটা আশা করছিলাম। কখনই নিশ্চিত না হয়ে বাচ্চাকে দোষাবেন না, যদি এরকমটা হয় যে সে ওটা করেনি কিন্তু আপনি তাকে সন্দেহ করে মিথ্যাবাদী বানায় দিচ্ছেন তখন সে অনেক কষ্ট পাবে এবং সত্য বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে মিথ্যের দিকে ধাবিত হবে। তাই একটু ভেবে চিন্তে কাজ করবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, শিশুরাই বেশি ভুল করবে এজন্য সে ছোট আর আপনি বড়।
আশা করি, আপনার বাচ্চার মিথ্যে বলার বদ অভ্যাস দূর হবে এই বিষয়গুলো মেনে চললে। একটু ধর্য্য আর নিয়মিত কৌশলের মাধ্যমে আপনি আপনার শিশুর যেকোন অভ্যাস দূর করতে পারেন। ছোট বয়সে যে অভ্যাস তৈরী হবে সেটা তার বাকি জীবনে প্রভাব ফেলবে। তাই কোন বদ অভ্যাস এড়িয়ে যাবেন না, ছোট বেলায় যত সহজে অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব বড় হয়ে কিন্তু তা সম্ভব না। আপনার শিশু একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক এই কামনা করি।
আরো পড়ুন- শিশুকে শাসন করার উপায়