শিশুদের কথা শেখানোর উপায় বয়স ভেদে – সকল বয়সের বাচ্চা এবার কথা বলবে: শিশুর দেরিতে কথা বলা বা শব্দ উচ্চারণ ঠিকমত না হওয়া ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে মায়েরা দুশ্চিন্তায় থাকে। অনেক সময় এই বিষয়গুলোকে মনগড়া ট্রিটমেন্ট যেমন- ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া ইত্যাদি নানা উপায় অবলম্বন করে অনেকে। যেটা বাচ্চার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে অনেক সমস্যা আর বড় আকার ধারণ করতে পারে না, বরং ঠিক হয়ে যায় পুরোপুরি। তো আজকে আমি আপনাদের সন্তানের কথা বলা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব। এমন কিছু সহজ পদ্ধতি বলব যা আপনি বাসায় বসে অনায়াসে করতে পারবেন। চলুন তবে শুরু করা যাক।
শিশুর কথা বলার সমস্যা
‘কথা বলতে শেখা’ এমন একটি প্রক্রিয়া যা জন্মের সময় থেকেই শুরু হয়। যখন আপনার শিশুটি মানব কণ্ঠ কীভাবে শব্দ করতে পারে তা অনুভব করে তখন থেকেই সে নানারুপ শব্দ তৈরি করে। ২ বছর বয়সী, বেশিরভাগ শিশুর একটি বড় শব্দভাণ্ডার রয়েছে। যেখানে তারা তাদের প্রয়োজন এবং ধারণাগুলি প্রকাশ করার জন্য শব্দগুলি একসাথে রাখতে পারে।
বাচ্চারা চারপাশের বিভিন্ন শব্দ মনযোগ দিয়ে শুনে এবং তা নিয়ে ভাবতে থাকে। যখন একবার সে বুঝতে পারে যে এই শব্দটি আসলে এই জায়গা থেকে আসছে তখন সে সেটা একেবারে ব্রেনের মধ্যে জমা করে রাখে। তারপর সে নিজেই এই শব্দটি ভালো লাগলে করতে শুরু করে, যেটা আমরা বুঝতে পারি না। কারণ সেটা সে চেষ্টা করছে কিন্তু হচ্ছে না, ছোট মানুষ বলে কথা। তবে অনেক বাচ্চারাই এটা করতে পারে, একেবারে হুবহু নকল!
শিশুরা অনুকরণ প্রিয়, তারা বাবা মায়ের অনুকরণ করে। তাই আপনার মুখ থেকেই সে প্রথম কথা বলা শিখে। এজন্য অনেক টেকনিক আছে যা আপনার বাচ্চার কথা বলা ও উচ্চারণ জড়তা দূর করবে। তবে বয়স ভেদে বাচ্চারা যেহেতু আলাদা চরিত্র বহন করে তাই টেকনিকগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। আসুন দেখি, আপনার শিশুর কথা শেখানোর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আপনি কী করতে পারেন?
শিশুদের কথা শেখানোর উপায় বয়সভেদে
তিন মাসের বাচ্চা থেকে শুরু করতে হবে। কারণ শিশু কথা বলতে না পারলেও মায়ের পেটে থাকা অবস্থা থেকে কথা শুনে, বুঝতে চেষ্টা করে। কোনটা কথা রাগী আর কোনটা কথা মিষ্টি তা সে বুঝে যায় অনায়াসে। তার প্রমাণ স্বরূপ যখন আপনি কারো সাথে ঝগড়া করেন বা উচ্চস্বরে কথা বলেন তখন খেয়াল করে দেখবেন যে পাশে থাকা শিশুটি কাঁদছে, সে বুঝতে পেরেছে পরিবেশ ঠিক নাই।
তাই মায়ের গর্ভাবস্থায় থাকা সময়ে মাকে বিভিন্ন ভাবে কবিতা, ছড়া পড়তে হবে, মাঝেমাঝে বাচ্চাকে শুনিয়ে কথা বলতে হবে, তাহলে দেখবেন এমনিতেই বাচ্চার কথা না বলার সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
আসুন দেখি কিভাবে আপনার শিশুটিকে কথা বলা শেখাবেন তা উদাহরণ সহ জেনে নেই।
৩ মাসের শিশুর কথা বলা
আপনার শিশু আপনার কন্ঠ শুনে। সে আপনাকে অনুকরণ করে এবং কলকল শব্দ করে। তারপর আপনার অনুরূপ শব্দ করার চেষ্টা করে। ‘কখন ভয়েস সুন্দর হয়’ কখন একটি কথা মানানসই হয় তা আপনি আপনার বাচ্চাকে এভাবে শেখাতে পারেন-
১। আপনার শিশুর কাছে গান করুন। আপনি তার জন্মের আগেই এটি করতে পারেন! মায়ের পেটে থাকা অবস্থায়ও আপনার শিশু আপনাকে শুনবে। আপনি যদি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনেন বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় তাহলে বড় হয়ে বাচ্চা এই সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হবে।
আবার ধর্মীয় কোন গল্প, কথা, বা সংগীত শোনান তাহলে সে সেটার প্রতি টান অনুভব করবে। তাই পেটে থাকা হোক আর নবজাতক হোক তার সামনে গল্পের বই পড়বেন, গুণ গুণ করে গাইবেন, মজার মজার ছড়া শোনাবেন। তাহলে বাচ্চাও এটি করতে চাইবে এবং মুখের জড়তা কাটিয়ে বলতে শুরু করবে।
২। আপনার শিশুর সাথে কথা বলুন। আপনার শিশু উপস্থিত থাকা অবস্থায় অন্যের সাথে কথা বলুন। এমতাবস্থায়, সে শব্দগুলি হয়তো বুঝতে পারবে না, তবে সে আপনার ভয়েস এবং আপনার হাসি পছন্দ করবে। সে অন্যদের কথা শোনা এবং অন্য লোকদের দেখতেও উপভোগ করবে। অবসরে বা অন্যসময় সে এটা হুবহু করার চেষ্টা করবে।
৩। বিশ্রামের সময়ের জন্য পরিকল্পনা করুন। বাচ্চাদের টিভি বা রেডিও বা অন্যান্য গোলমাল ছাড়াই নিঃশব্দে আধো আধো স্বরে বা অসংলগ্নভাবে কথা বলা এবং খেলার জন্য সময় প্রয়োজন।
তাই সময় বের করে বিভিন্ন শব্দের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিন। যেমন- কখনো সিংহ, কখনো বাঘের শব্দ থেকে শুরু করে নতুন নতুন শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। সে শুনবে, তা ব্রেণ সেটা নিয়ে ভাববে এবং হুবহু করার চেষ্টা করবে।
৩ থেকে ৬ মাসের বাচ্চার কথা বলা
লোকেরা একে অপরের সাথে কীভাবে কথা বলে তা আপনার শিশু শিখতে থাকে। আপনি যখন কারো সাথে গল্প করেন তখন আপনি তাকে একজন ‘কথক’ হতে সহায়তা করতে পারেন। নিচের পদ্ধতিগুলো করার চেষ্টা করুন-
১। আপনার বাচ্চাকে কাছে ধরুন যাতে সে আপনার চোখে দেখে।
২। তার সাথে কথা বলে হাসি দিন।
৩। আপনার বাচ্চা যখন অস্ফুট স্বরে বলা কথা বলার চেষ্টা করে তখন তার তৈরি শব্দগুলি অনুকরণ করুন।
৪। যে শব্দটি আপনি করেছেন সে যদি একই শব্দটি পুনরায় করার চেষ্টা করে তবে আপনিও পুনরায় শব্দটি অনুকরণ করুন।
এভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে তার সাথে সময় কাটান। এতে কথা বলা সহজ হবে এবং শিশু কথা বলতে উৎসাহী হবে। আর মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক মুজবুত হবে।
৬ থেকে ৯ মাসের বাচ্চার কথা বলা
আপনার বাচ্চা শব্দ করে খেলবে। এই শব্দগুলির মধ্যে কিছু শব্দ যেমন “বাবা” দাদা ইত্যাদি। এসময় খুশিমূলক কোনো কথাবার্তা শুনে বাচ্চা হাসে এবং ধমক শুনে কাঁদে বা তাকে দেখতে অসন্তুষ্ট লাগে। বাচ্চাকে এরকম ছোট ছোট শব্দগুলি বুঝতে আপনি সাহায্য করতে পারেন। (যদিও সে এখনও সেগুলি বলতে পারে না)
১। বাচ্চাকে নিয়ে খেলুন, তাকে পিঠে চড়িয়ে ঘোড়ার মত শব্দ করুন আবার কখনো হাতির মত। এতে শিশু উৎসাহ পায় এবং হাসতে গিয়ে শব্দ তৈরী করে। আবার বইয়ের ছড়া পড়তে পড়তে সেখানে থাকা ছবির সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিন এবং তার হাত দিয়ে ছবিগুলো স্পর্শ করুন।
২। তাকে একটি খেলনা দিন এবং এটি সম্পর্কে কিছু বলুন। যেমন- দেখ বাবা/মা এই গাড়িটার রং লাল, এটির চারটি চাকা।
৩। আপনার শিশুকে একটি আয়না দিন এবং নিজেকে দেখতে দিন। তারপর জিজ্ঞাসা করুন, “সে কে?” সে যদি সাড়া না দেয়, তাহলে তার নাম বলুন।
৪। আপনার বাচ্চাকে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট প্রশ্ন করুন। যেমন “কুকুর কোথায়?” যদি সে উত্তর না দেয় তবে কোথায় তাকে দেখান।
এভাবে নিত্য নতুন কোন বিষয় নিয়ে বাচ্চাকে গাইড করুন। তবে একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, বাচ্চাকে কখনো জ্বোর করবেন না। হাসিখুশি মেজাজে তার সাথে এগুলো করুন। কোন কারণে করতে না চাইলে আগে তার মন ভালো করে নিন তারপর করার চেষ্টা করুন।
৯ থেকে ১২ মাস বয়সের শিশুর কথা বলা
এ সময় আপনার শিশু সহজ সহজ শব্দ বুঝতে শুরু করবে। আপনি “না-না” বললে সে আপনার দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে “মা কোথায়?” সে মায়ের খোজ করবে এবং এদিক ওদিক তাকাবে। সে ইঙ্গিত করবে, শব্দ করবে এবং সে কী চায় তা আপনাকে “বলার” জন্য তার শরীরটি ব্যবহার করবে।
উদাহরণস্বরূপ, সে আপনার দিকে চেয়ে থাকতে পারে এবং তার হাতগুলো উপরে তুলে কোমরটা নাচাতে পারে। এর মানে সে উপরে উঠতে চায়, এটা আপনাকে বোঝাতে চাচ্ছে। ‘সে এখন খেলতে চায়’ এটা আপনাকে বোঝানোর জন্য আপনার হাতে একটা খেলনা দিতে পারে। আপনি যখন আপনার শিশুকে “কথা বলতে” সহায়তা করতে পারেন। আপনি কীভাবে অন্যকে বিদায় দেয়ার সময় “বাই বাই” বলেন তা তাকে দেখান।
তাকে বাস্তবিক কথার দিকে নিয়ে যান। কোন নীতি মূলক বা ইশপের গল্প তাকে শুনান, তার মনে প্রশ্ন তৈরী হবে। আর সেটা বলার চেষ্টা করবে, দেখবে বাচ্চার যত কথা বলে বেশিরভাগটাই প্রশ্ন। তাই কোন শিশু যদি কথা না বলে তাহলে আপনার প্রথম কাজ হবে এমন সব কথা বলা যেখানে প্রশ্ন করতে অনেক কৌতুহল জাগবে। ঠিক এই টেকনিকটি কাজে লাগিয়ে আপনি বাচ্চাকে সহজে কথা বলা শেখাতে পারেন।
এক থেকে দেড় বছরের সন্তানের কথা বলা
এ সময় বাচ্চারা শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করে। কোনো কিছু খুঁজতে তারা একই শব্দকে ধারাবাহিকভাবে বারবার বলতে থাকে। যেমনঃ বোতলের জন্য “বাবা” কিংবা জুস এর জন্য “জুজু”। এই বয়সে অনেক শিশুই একটি বা দুটি শব্দ করে থাকে। কিন্তু তারা ২৫ টিরও বেশি শব্দ বুঝতে পারে।
আপনি যদি তার কাছে কোনো খেলনা চান তবে সে আপনাকে একটি খেলনা দেবে। এমনকি কোনও শব্দ ছাড়াই, সে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে, জিনিসটি নির্দেশ করে, জিনিসটির কাছে পৌঁছে গিয়ে বা জিনিসটি দেখিয়ে বা অস্ফুট শব্দে। আপনি আপনার বাচ্চাকে শব্দগুলি বলতে সহায়তা করতে পারেন এভাবে –
১। আপনি যে সমস্ত জিনিস দৈনন্দিন ব্যবহার করেন সেগুলোর নাম তাকে বলুন। যেমনঃ “কাপ”, “জুস”, “পুতুল” এর মতো শব্দগুলি ব্যবহার করুন। একঘেয়েমি বারংবার না বলে বাচ্চাকে বেশ কয়েকদিন সময় দিন সেগুলোর নাম বলতে।
২। বইগুলিতে থাকা ছবিগুলো সম্পর্কে আপনার বাচ্চাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন। আপনার শিশুকে ছবির জিনিসগুলোর নামগুলো জানতে কয়েকদিন সময় দিন।
৩। আপনার শিশু যখন কোন জিনিস দেখে সেগুলোর বলতে পারে তখন হাসুন বা হাততালি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর জিনিসটি সম্পর্কে তাকে আরো কিছু বলুন। যেমনঃ “তুমি কুকুর দেখছো। এটি অনেক বড়! তার লেজ নাড়ানোটা শুধু একবার দেখই না কতটা সুন্দর।”
৪। ‘আপনার শিশু কোন বিষয়টা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলতে চায়’ সে সম্পর্কে তার সাথে কথা বলুন। পুরো বিষয়টি একেবারে বলে তার জানার কৌতুহল নষ্ট করে দিবেন না। বরং একটু সময় নিয়ে অল্প অল্প করে তাকে জানান।
৫। আপনি প্রতিদিন যে কাজগুলি করেন সেগুলো সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করুন। তাকে জিজ্ঞাসা করুন এভাবে- “তুমি আজকে কোন রঙয়ের শার্ট পড়েছ, জান?” তুমি আজকে লাল কালারের শার্ট পড়েছ। “তোমার কি দুধ বা জুস প্রয়োজন আছে?”
৬। আপনার বাচ্চা যা বলে তার উপর ভিত্তি করে আরো কিছু শেখান। যদি সে “বল” বলে, তাহলে আপনি বলতে পারেন, “এটি হলো তোমার বড়, লাল বল।”
৭। আপনার সন্তানের পছন্দসই পুতুল বা খেলনা প্রাণীর সাথে খেলার ভান করান। এটি আপনার কথোপকথন এবং আপনার খেলায় অন্তর্ভুক্ত করুন। যেমনঃ “রোভারও খেলতে চায়। সে কি আমাদের সাথে বলটি গড়িয়ে নিতে পারবে? ”
কথা বলার সময় অবশ্যই কোমল ভাবে বাবা/মা সম্বোধন করে বলুন। তার কাছ থেকে প্রশ্ন করুন, মতামত দিন। সে যেন বুঝতে পারে যে তাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। দেখবেন এমনিতেই সে আগ্রহ নিয়ে কথা বলবে।
আর তার কোন প্রশ্নের মনগড়া বা উল্টাপাল্টা জবাব দিবেন না, যেটা সত্য সেটাই বলুন, যদি আপনার সন্তানকে সত্যবাদী বানাতে চান। কারণ সে যখন দেখবে তার বাবা মা মিথ্যা কথা বলে তখন সেও মিথ্যা বলতে চাইবে।
১৫ থেকে ১৮ মাস বয়সী শিশুর কথা বলা
আপনার শিশু আপনার সাথে যোগাযোগের জন্য আরও জটিল অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করবে এবং তার শব্দভাণ্ডার তৈরি করতে থাকবে। সে আপনার হাত ধরবে, আপনাকে বইয়ের শেলফের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তখন কোনও বইয়ের দিকে ইঙ্গিত করুন এবং “বুক” শব্দটি বলতে পারেন। এরপর বলুন “আমি তোমার সাথে একটি বই পড়তে চাই।” আপনি আপনার সন্তানকে আপনার সাথে কথা বলতে সহায়তা করতে পারেন এভাবে-
১। তাকে বলুন “আমাকে তোমার নাক দেখাও।” তারপরে আপনার নাকের দিকে ইশারা করুন। এতে করে সে শীঘ্রই তার নাকের দিকে ইঙ্গিত করবে। পায়ের আঙ্গুল, হাতের আঙুল, কান, চোখ, হাঁটু এবং আরও কিছু দিয়ে এটি করুন। দেখবেন, আপনার বাচ্চা খুব দ্রুত এগুলো চিনবে এবং বলতে শিখবে।
২। তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেলনা লুকিয়ে রাখুন। এরপর তাকে খেলনাটি খুঁজে পেতে এবং তার আনন্দ ভাগ করে নেওয়াতে সহায়তা করুন।
৩। যখন সে আপনাকে কিছু নির্দেশ করে বা আপনাকে কিছু দেয়, তখন তার সাথে ঐ বস্তুর বিষয়ে কথা বলুন। “তুমি আমাকে বইটি দিয়েছ। ধন্যবাদ!
এভাবে বাচ্চাকে উৎসাহ ও পুরষ্কার দিয়ে সুন্দরভাবে কথা বলতে উৎসাহিত করুন। তাকে গালাগাল বা ধমক না দিয়ে বুঝিয়ে বলুন কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ। আপনি শুধু আপনার সন্তানকে কথা বলা শেখাচ্ছেন না বরং তাকে ভালো মানুষ হিসেবে তৈরী করছেন এটা ভেবে সে হিসেবে কাজ করুন। শিশুদের কথা শেখানোর উপায় গুলোর মধ্যে এটি খুবই কার্যকরী একটি পদ্ধতি।
১৮ মাস থেকে ২ বছর বয়সের বাচ্চার কথা বলা
আপনার বাচ্চা দিকনির্দেশগুলি অনুসরণ করতে সক্ষম হবে এবং একসাথে শব্দ বলতে সক্ষম হবে। যেমনঃ ‘গাড়ি যায়’, ‘জুস চাই’ এর মতো শব্দগুলি একসাথে বলতে শুরু করবে। সে ভাষার বিকাশকে উত্সাহিত করে এমন ভান করা খেলাও খেলতে শুরু করবে। আপনি আপনার সন্তানের কথা বলার দক্ষতা জাগাতে পারেন এভাবে-
১। আপনার শিশুকে আপনাকে সহায়তা করতে বলুন। উদাহরণস্বরূপ, তাকে কাপটি টেবিলের উপরে রাখতে বা তার জুতো আপনার কাছে আনতে বলুন।
২। আপনার শিশুকে সাধারণ গান এবং নার্সারি ছড়া শিখিয়ে দিন। আপনার সন্তানের কাছে পড়ুন। সে কী দেখছে তা আপনাকে নির্দেশ করতে এবং বলতে বলুন।
৩। আপনার সন্তানকে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সাথে কথা বলতে উৎসাহিত করুন। সে তাদের একটি নতুন খেলনা সম্পর্কে বলতে পারেন।
৪। আপনার সন্তানকে খেলার ভান করা শেখান। এর জন্য আপনি একটি প্লে ফোনে কথা বলতে পারেন, পুতুলগুলিকে খাওয়াতে পারেন বা খেলনা পশুদের সাথে পার্টি করতে পারেন।
তবে এ বয়সে বাচ্চা কথা একেবারে বলতে না পারাটা কিছুটা চিন্তার। আপনি এসব চেষ্টা করেও যদি ফল না হয় তবে ভালো শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। শিশুর দেরিতে কথা বলা অবশ্যই একটি চিন্তার বিষয়, তাই হেয়ালি করবেন না।
২ থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুর কথা শেখা
আপনার সন্তানের ভাষার দক্ষতাগুলো খুব দ্রুত ও সীমাবদ্ধ হয়ে বৃদ্ধি পাবে। সে আরও সহজ শব্দগুলির দ্বারা একসাথে সরল বাক্য তৈরি করবে। যেমনঃ “ম্যামি বাই বাই বাই”। সে সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবে। যেমনঃ “তোমার ভালুকটি কোথায়?”
৩৬ মাসের মধ্যে সে আরও জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবে। যেমনঃ “ক্ষুধার্ত হলে তুমি কী করবে?” এসময় সে আরও বেশি করে খেলার ভান করবে। যেমনঃ কাজ করতে যাওয়া, খেলনা গাড়ি ঠিক করা, তাঁর “পরিবারের” (পুতুল, প্রাণীর) যত্ন নেওয়ার মতো কাল্পনিক দৃশ্যের অভিনয় করবে।
আপনি আপনার বাচ্চাকে তার সমস্ত নতুন শব্দ একসাথে বলতে এবং তাকে এমন জিনিস শিখতে সাহায্য করতে পারেন যা জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণঃ
আপনার বাচ্চার নাম বা প্রথম এবং শেষ নাম বলতে শেখান। আপনার শিশুকে তার সামনে প্রদর্শিত জিনিসগুলির সংখ্যা, আকার এবং গঠন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন। “হ্যাঁ” বা “না” উত্তর নেই এমন মুক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন। এটি তাদের নিজস্ব ধারণা তৈরি করতে এবং তাদের প্রকাশ করতে শিখতে সহায়তা করে। যদি এটি কীটপতঙ্গ হয় তবে আপনি বলতে পারেনঃ “কী মোটা, কৃপণ! তারা কয়জন আছে?
তারা কোথায় যাচ্ছে? অপেক্ষা করুন, দেখুন এবং উত্তরটি শুনুন। প্রয়োজনে আপনি একটি উত্তর প্রস্তাব করতে পারেনঃ “আমি পাঁচটি দেখতে পাচ্ছি। তারা কি পার্কে বা দোকানে যাচ্ছেন?” আপনার সন্তানকে এমন গল্প বলতে বলুন যা তার প্রিয় বইয়ের সাথে যায়। “এই তিনটি হাতির কী হল?” পড়াশোনার ফলে ভাষার বিকাশ হয়। আপনার স্থানীয় লাইব্রেরিতে গল্পের সময় তাকে নিয়ে যান।
আপনার ছোট বাচ্চা আপনার সাথে বইটি সমবয়সীদের পাশাপাশি উপভোগ করবে। প্রচুর খেলার ভান করা খেলুন। গল্পগুলি অভিনয় করা এবং ভূমিকা পালন করাই ভাষা ব্যবহার এবং শেখার জন্য প্রচুর সুযোগ তৈরি করে। আগে যা কাজ করেছে তা ভুলে যাবেন না।
উদাহরণস্বরূপ, আপনার সন্তানের এখনও বিশ্রামের সময় প্রয়োজন। তবে মনে রাখবেন, এটি কেবল ন্যাপের (দুপুর বেলার স্বল্প ঘুম) জন্য নয়। টিভি এবং রেডিও বন্ধ করুন। আপনার সন্তানকে শান্তভাবে খেলতে, গান করতে এবং আপনার সাথে কথা বলতে উপভোগ করুন।
উপসংহার
শিশুর কথা বলার সমস্যা বেশিরভাগ সময় স্বাভাবিক কোন সাধারণ সমস্যার জন্য হয়। আপনি যদি বয়সভেদে উপরের বিষয়গুলো করার চেষ্টা করেন তাহলে আশা করি আপনার শিশু কথা বলবে।
তারপরেও কিছু বড় ও জন্মগত সমস্যা থাকে যেগুলো ডাক্তার ঠিক করতে পারে আবার কখনই ঠিক হয় না। বাচ্চাদের স্পিচ থেরাপি কিছু ট্রিটমেন্ট আছে যা বেশ কার্যকর। তবে আপনার সন্তান কথা যদি নাও বলতে পারে তবু চিন্তিত হবেন না, সঠিক শিক্ষা ও স্বাভাবিক বাচ্চার মত তাকেও সুযোগ করে দিন, দেখবেন সে পৃথিবী জয় করবে।
আশা করি, আপনাদের কাজে লাগবে বিষয়গুলো। আপনার শিশু স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবন পাক এই কামনা করি। আমাদের সাথেই থাকবেন, আপনার বিভিন্ন প্রশ্ন আমাদের কমেন্ট করতে পারেন, আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করব আপানকে উত্তর দেয়ার। ভালো লাগলে পোস্টটি শেয়ার করুন, যাতে অন্য মায়ের বাচ্চা কথা বলার সমস্যা থেকে মুক্তি পায়। ভালো থাকুন, পরিবার ও সন্তানকে সময় দিন।
প্রশ্ন – উত্তর পর্ব
স্পিচ থেরাপি হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা। যার সাহায্যে কথা বলতে না পারা অথবা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না এমন রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। সাধারণত তোতলামি, শিশুদের দেরিতে কথা বলা, কানে কম শোনাজনিত কথা বলার সমস্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে যারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না, তাদের প্রাণখুলে কথা বলার সুযোগ করে দেয় স্পিচ থেরাপি।
দাঁত, জিহ্বা, তালু, ভোকালকর্ড ইত্যাদি অঙ্গের মিলনে আমরা কথা বলি। এর যে কোনোটির সামান্য সমস্যা হলে স্বাভাবিক কথা বলা সম্ভব হয় না। স্পিচ থেরাপিস্টরা তাই বাকপ্রতিবন্ধীদের কিছু কায়দা-কানুন শিখিয়ে দেন ও চর্চা করান। প্রয়োজনে তারা অপারেশনের সহায়তা নেন।
শিশুর দেরিতে কথা বলা সমস্যা বুঝব কিভাবে?
শিশু প্রথম বছর একটি শব্দ, দ্বিতীয় বছর দুটি শব্দ এবং তৃতীয় বছর পুরো বাক্য বলতে পারবে। এর ব্যতিক্রম হওয়া মানেই শিশু কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছে। এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। শিশু বড় হলে সমস্যাটি ঠিক হয়ে যাবে এমন ভাবনা ঠিক নয়।
শিশুর দেরীতে কথা বলার কারণ কি?
শিশুর বংশগত কারণ, মস্তিষ্কের জন্মগত সমস্যা, প্রসবকালীন জটিলতা, জিহ্বার ত্রুটি, বাচ্চার মানসিক প্রতিবন্ধকতা, বাচ্চার সামনে ঝগড়া করলে বা অত্যধিক উচ্চস্বরে কথা বললে নার্ভাসনেসের কারণে তাদের কথা জড়িয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।
জিহ্বা আটকানো বা টাং টাই কি?
কোনো বাচ্চার ক্ষেত্রে জিহ্বা সামনের দিকে টাইয়ের মতো পাতলা মাংস দিয়ে মুখ গহ্বরের সঙ্গে লেগে থাকে। ফলে জিহ্বা স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করে না। এ ধরনের সমস্যাকে বলা হয় টাং টাই। টাই স্মার্টনেসের প্রতীক হলেও জিহ্বার টাই মোটেও সুখকর নয়। এ ধরনের সমস্যা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।
কিভাবে তোতলা ভালো হয়?
তোতলামি সমস্যা সব দেশেই সব বংশের বাচ্চাদের আছে। তবে এ ধরনের রোগীদের জন্য সরাসরি চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তোতলামির সঠিক কারণ না থাকলেও প্রায়ই দেখা যায় অতিরিক্ত টেনশন, কথা বলতে গিয়ে নার্ভাস হওয়া, দ্রুত কথা বলার চেষ্টা করা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি কারণে অনেকে তোতলায়। অনেক সময় স্পিচ থেরাপিস্টদের সহায়তায় ৫-৬ মাসে এ ধরনের বাচ্চারা প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠে। মুখে কথা আটকে যাওয়ার সমাধান হয়ে যায়।
উচ্চারণগত সমস্যা কেন হয়? সমাধান কি?
অনেক শিশু আছে যারা বাংলা বর্ণমালাগুলো শুদ্ধরূপে উচ্চারণ করতে পারে না। যেমন ‘ত’ কে সর্বদা ‘প’ উচ্চারণ করা, ‘ল’ কে ‘ড’ উচ্চারণ করা ইত্যাদি। এসব শিশু স্পিচ থেরাপিস্টদের সহায়তায় খুব দ্রুত স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে। অথবা বাবা-মা চেষ্টা করে এটি ঠিক করতে পারে। উপরে বলা বিষয়গুলো করার চেষ্টা করুন আশা করি সমাধান হয়ে যাবে।
ঠোঁট বা তালু কাটাজনিত কথা বলার সমস্যা সমাধান কি?
আজকাল প্লাস্টিক সার্জারির কল্যাণে ঠোঁট কাটা বা তালু কাটা রোগীরা স্বাভাবিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা যায় অপারেশন পরবর্তী সময়ে কথা বলতে গেলে, কেননা ঠোঁট বা তালু কাটা থাকার কারণে তারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত থাকে না। স্পিচ থেরাপিস্টদের সহায়তা নিলে বা বাবা মা নিয়ম মত জেনে সেভাবে চেষ্টা করলে এ ধরনের সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায়।
বাচ্চার কম শোনাজনিত সমস্যার সমাধান কি?
বাচ্চার কম কথা বলার আরেকটি অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে কথা ঠিকমত না শোনার কারণে বা কানের সমস্যা থাকলে। হেয়ারিং এইডসের (কানে শোনার যন্ত্র) মাধ্যমে অনেক বাচ্চার শোনার ব্যবস্থা করা গেলেও বিড়ম্বনা দেখা দেয় কথা বলার ক্ষেত্রে। স্পিচ থেরাপিস্টরা সহজেই এ ধরনের সমস্যা দূর করতে পারেন। এছাড়াও কণ্ঠস্বর পরিবর্তন, ফ্যাঁসফ্যাঁসে কথা বলা, নাকি সুরে কথা বলা ইত্যাদি সমস্যা দূরীকরণে স্পিচ থেরাপিস্টদের জুড়ি নেই।
Note: Some information was adapted, with permission, from Learning Link: Helping Your Baby Learn to Talk, by C.E. Morrisset Huebner and P. Lines, 1994, Washington, DC: U.S. Department of Education, Office of Educational Research and Improvement.)